এরা অনেকেই মনে করে আমি যাহা করি সকল কিছুই তাঁর মত নিয়ে করে থাকি আমার দরকার হলে আমিই তাঁর কাছে যাই পরামর্শের জন্য । তিনি কখনও গায়ে পড়ে কোনোদিন পরামর্শ দেবার চেষ্টা করেন নাই তবে তাঁর সাথে আমার মনের মিল আছে, কারণ ২৫ বৎসর এক নেতার নেতৃত্ব মেনে এসেছি দুইজন অনেকেই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে বেইমানী করেছেন আমরা দুইজন একদিনের জন্যও তাঁর কাছ থেকে দূরে যাই নাই পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের জন্য ইত্তেফাক যা করেছে তা কোনো খবরের কাগজই দাবি করতে পারে না । এদেশ থেকে বিরুদ্ধ রাজনীতি মুছে যেত যদি মানিক মিয়া এবং ইত্তেফাক না থাকতো । একথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ করা হবে । ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর থেকে হাজার রকমের ঝুঁকি লইয়াও তিনি এদেশের মানুষের মনের কথা তুলে ধরেছেন
ছয় দফার আন্দোলন যে আজ এত তাড়াতাড়ি গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে এখানেও মানিক ভাইয়ের লেখনী না হলে তা সম্ভব হতো কিনা তাহা সন্দেহ! আমি যাহা কিছু করি না কেন, তাহা মানিক ভাইয়ের দোষ, সরকারের এটাই ভাবনা । ভারতবর্ষ যখন পাকিস্তান আক্রমণ করল তখন যেভাবে ইত্তেফাক
কাগজ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে এবং জনগণকে উদ্বুব্ধ করেছে—ত্যাগের জন্য ও মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য, ইত্তেফাকের পাতা খুললেই তাহা দেখা যাবে । তবুও আজ তাকে ডিপিআরএ গ্রেপ্তার করা হয়েছে । এখন বুঝতে কারও বাকি নাই কেন জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করছেন না সরকার । দেশরক্ষা করার জন্য যে আইন করা হয়েছিল সে আইন আজ রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে । খবরের কাগজের স্বাধীনতার উপর পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করিতেছে । এমনকি মানিক মিয়ার মতো সম্পাদককেও দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করতে একটু লজ্জা করল না । তফাজ্জল হোসেন সাহেব, যাকে আমরা সকলে মানিক ভাই বলে ডাকি তিনি শুধু ইত্তেফাকের মালিক ও সম্পাদক নন, তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ইনস্টিটিউটের পাকিস্তান শাখার সভাপতি এবং প্রেস কোর্ট অব অনারের সেক্রেটারি ।
১৯৫৯ সালে আমি যখন জেলে ছিলাম আমাকে তখনও একাকী রাখা হয়েছিল । মানিক ভাইকে গ্রেপ্তার করে পুরানো ২০ সেলে রাখা হয়েছিল । সকালে ও বিকালে কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার সাথে তাঁর দেখা হতো । তখন তিনি বোধ হয় একমাস কি দেড়মাস ছিলেন মানিক ভাইকে খুবই কষ্টে রাখা হয়েছিল । ১৯৬২ সালে গ্রেপ্তার হয়ে তাঁকে আমি জেল গেটে এসে পাই যতদিন জেলে ছিলাম একসাথেই ছিলাম সকলে খালাস হয়ে গেলেও আমি আর মানিক ভাই ছিলাম মানিক ভাই অসুস্থ হয়ে বাইরের হাসপাতালে গেলে আমি একলাই ছিলাম । কয়েকদিন পরেই আমাকে মুক্তি দেওয়া হয় ।
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭ লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
কারাগারের রোজনামচা : পর্ব-৬১
কারাগারের রোজনামচা : পর্ব-৬০
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী