36 C
আবহাওয়া
১১:০৯ পূর্বাহ্ণ - এপ্রিল ২০, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » ইতিহাসের সাক্ষী কল-রেডী

ইতিহাসের সাক্ষী কল-রেডী


।। সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া ।।

বিএনএ ,ঢাকা: বিয়ে বাড়ি, উৎসব, কনসার্টসহ রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ছাড়া যেন চলেই না। ঢাকায় এই মাইক ১৯৪৮ সালে প্রথম নিয়ে আসে ‘কল-রেডী’। মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল করলেই যেন তাদের প্রতিষ্ঠান রেডি থাকে এই ভাবনা থেকেই ‘কল রেডী’ নামকরণ। অর্থাৎ কল করলেই মূহুর্তে মাইক পৌঁছে যাবে। ১৯৪৮ সালে ঢাকা শহড়ে এই মাইক প্রথম নিয়ে আসেন পুরান ঢাকার হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই।

এর পর থেকে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে ওঠে ‘কল-রেডী’। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশে এই প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোফোনের সামনে অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেছেন দেশবরেণ্য রাজনীতিকগণ। বিদেশীদের মধ্যে কল- রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রমুখ। দেশের রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ‘কল-রেডি’ মাইক সার্ভিসের মাইকে ঐতিহাসিক ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ভাষণ শুনে ৭ কোটি বাঙ্গালি নিজেদের যোদ্ধা হিসেবে তৈরির শক্তি পেয়েছিলো। যে ভাষণ জাতির মুক্তির স্বপ্নে জড়িয়ে আছে। আর সেই ভাষণের সঙ্গে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে ‘কল-রেডী’। প্রতিষ্ঠানটি সেদিন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় সাউন্ড সিস্টেমের দায়িত্ব পালন করে।

এটি অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের বিষয় যে, ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের সেরা ভাষণগুলো নিয়ে ‘উই শ্যাল ফাই অন দ্য বিচেস : স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার হিস্ট্রি’ নামে যে বই প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করেন বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তৃতা হিসেবে। এরপর ইউনেস্কো এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়ে অবশ্যকর্তব্য পালন করেছে। ভাষণটি এখন বৈশ্বিক সম্পদ।

কল রেডী

কল-রেডীর ইতিহাস থেকে জানা যায়, হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই, পুরান ঢাকায় ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাবার ইচ্ছে ছিল দুই সন্তান ইসলামপুরে কাপড়ের পাইকারী দোকান দেবেন। কিন্তু পুরান ঢাকায় তখন কাপড়ের দোকানের ছড়াছড়ি থাকায় তাদের আগ্রহ ছিল না এ ব্যবসায়। তখন দুই ভাই সিদ্ধান্ত নেন বাতি ও লাইটের ব্যবসা করবেন। পুরান ঢাকার মানুষ আলোকসজ্জা পছন্দ করে, বেশ ভালো চলবে। এরপর দুজন ১৯৪৮ সালে ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি দোকান চালু করেন। দোকানের প্রথম গ্ৰাহক ছিলেন স্থানীয় শ্যামলকান্তি বড়াল। তখনকার অগ্রীম ৩ টাকা দিয়ে তিনি বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার দায়িত্ব দিয়ে যান দুই ভাইকে।

কিন্তু সমসাময়িক আরও অনেক দোকান গড়ে ওঠায় শঙ্কায় পড়েন তারা। এমন সময় বুদ্ধি খাটিয়ে লাইটের পাশাপাশি ব্যবসায় সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করার কথা চিন্তা করেন হরিপদ ঘোষা। শুরুতে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া ও আলোকসজ্জার কাজ করতেন। চাহিদা দিন দিন বাড়তে লাগলো। প্রথম দিকে ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে এসে এবং নিজেরাই হ্যান্ড মাইক তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা- সমাবেশে ভাড়া দেওয়া শুরু করেন।কিন্তু এক সময় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীন, তাইওয়ান ও জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও মাইক আনতে হয় দুই ভাইকে।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে আছেন সাগর ঘোষ, রানা ঘোষ, বিশ্বনাথ ঘোষ ও শিবনাথ ঘোষ। তারা চার ভাই। প্রতিষ্ঠানেই সাগর ঘোষের সাথে দেখা। সাগর ঘোষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেননি। তবে বাবা হরিপদ ঘোষের মুখে অনেক গল্প শুনেছেন। বঙ্গবন্ধু হরিপদকে স্নেহ করে ‘পাগলা’ ডাকতেন- বলেন সাগর ঘোষ। পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং কিংবা তার আশপাশে এলে বঙ্গবন্ধু হরিপদের খোঁজখবর নিতেন বলে ছেলে সাগর ঘোষকে জানিয়েছেন তার বাবা।

৭ মার্চ, ১৯৭১ সালের ভাষণের আগের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাগর ঘোষ জানান, ৭ মার্চের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসভবনে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ডেকে নেন। তিনি রেসকোর্স ময়দানে মাইক লাগানোর নির্দেশ দেন। এ সময় দুই ভাই জানতে চান কত মাইক লাগাতে হবে? বঙ্গবন্ধ সেদিন সংখ্যাটা বলেননি। উদীপ্ত কণ্ঠে নির্দেশ দেন- যতো পারো ততো, বলেন সাগর ঘোষ। এরপর একশোর অধিক মাইক লাগানো হয় জনসমাবেশ স্থলে। সমাবেশের তিনদিন পূর্ব থেকেই রাতের আঁধারে মাইকগুলো প্রস্তুত রাখার কাজ শুরু করে কল- রেডী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু মাইক মজুদ রাখা হয়। সে সময় পাকিস্তানি শাসকের ভয় উপেক্ষা করে কাজ করেছিল ঐতিহাসিক এ প্রতিষ্ঠানটি।

৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড ব্যবহার করেন বর্তমানে কল-রেডীর কাছে সেগুলো সংরক্ষিত আছে। প্রধানমন্ত্ৰী চাইলে সেসব হস্তান্তর করবেন বলে জানান সাগর ঘোষ। তবে তিনি সেগুলো প্রতিবেদককে দেখাতে বা সেগুলোর কোনো আলোকচিত্র দেখাতে রাজী হননি। সাগর ঘোষ বলেন, ‘ইতিহাসের অংশ আমাদের এই প্রতিষ্ঠান। খুব গর্ব হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাইকে কথা বলে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন- এর চেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে! আমরা সেই মাইক্রোফোন সংরক্ষণ করে রেখেছি। চাইলে যেকোন সময় সেগুলো প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিব। কেননা এগুলো আরও ভালোভাবে সংরক্ষণ প্রয়োজন।

বিএনএ/এমএফ

Loading


শিরোনাম বিএনএ