।। সৈয়দ সাকিব।।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির ২০০৯ সালের সেক্রেটারি শিশির মনিরের এই বক্তব্য এখন টক অব দ্যা কান্টি। গ্রামের চা দোকান থেকে রাজনৈতিক দলের অফিসে চলছে না ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। গত ২৯শে সেপ্টেম্বর জামায়াত ইসলামী নেতা সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট শিশির মনিরের এ বক্তব্যের বিষয়ে দলীয়ভাবে প্রত্যাখান করেনি, বলা হয়নি-এটি শিশির মনিরের ব্যক্তিগত মতবাদ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন পেতে জামায়াত ইসলামী এখন কট্টর বা ডানপন্থী অবস্থান থেকে সরে এসেছে। দলীয় লগো থেকে সরিয়ে নিয়েছে আল্লাহ এবং আকিমুদ্দিন অর্থাৎ দ্বিন প্রতিষ্ঠার শব্দ গুলো। নারীদের পোষাক, চলাফেরা, স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের বিষয়ে এখন অনেকটা নমনীয়।
এক কথায় শরিয়াহ আইন ও জীবনযাপন থেকে সরে এসে ম্মার্ট মডারেট মুসলিম রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় জামায়াত ইসলামী। আর এসবের মূলে রয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। ২৪ পরবর্তীতে অআওয়ামী লীগবিহীন রাজনৈতিক মাঠে জামায়াত ইসলামীর জন্য এখনই শ্রেষ্ট সময়।
দলটি ইতোমধ্যে তিন শত আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে মুসমানদের রোজা ও হিন্দুদের পূজা একই বলা শিশির মনির অন্যতম। তিনি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সুনামাগঞ্জ -২ সংসদীয় অআসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
এবার আসা যাক জামায়াত ইসলামী নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা শিশির মনির কত ভোট পাবেন সেই বিশ্লেষণে।
হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ – ২ সংসদীয় আসনটি দিরাই ও শাল্লা উপজেলা নিয়ে গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ২২৫ তম আসন।
১৯৯১ সালের ২৭ই ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই আসনে ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৫৮ হাজার ২ শত ৪৫ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ১ হাজার ২ শত ৯৪ জন। নির্বাচনে গনতন্ত্রী পার্টির সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বিজয়ী হন। কবুতর প্রতীকে তিনি পান ৫৮ হাজার ৫ শত ৮০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির দবিরুল ইসলাম । লাঙ্গল প্রতীকে তিনি পান ৩৬ হাজার ৬৭ ভোট ।
১৯৯৬ সালের ১২ই জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩ শত ৯৬ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ২১ হাজার ১ শত ৯২ জন। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নাছির উদ্দীন চৌধুরী বিজয়ী হন। লাঙ্গল প্রতীকে তিনি পান ৫৯ হাজার ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত । নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৫৮ হাজার ৪ শত ৯৬ ভোট।
২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭ শত ৪২ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ৫০ হাজার ৫ শত ৮২ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৮২ হাজার ৮ শত ৩৯ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির নাছির উদ্দীন চৌধুরী । ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৬৬ হাজার ৫ শত ৫৮ ভোট।
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৯৪ হাজার ৫ শত ৬২ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ১ শত ৫৮ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৯৪ হাজার ৭ শত ১৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির নাছির উদ্দীন চৌধুরী। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৭৬ হাজার ৭ শত ৬৬ ভোট।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে র্নিবাচনের দাবিতে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এই নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেনি।
২০১৭ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। পরবর্তীতে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তাকে মনোনয়ন দেয় এবং তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের জয়া সেন গুপ্তা, ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির নাছির উদ্দীন চৌধুরীসহ ৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু ভোটের আগের রাতে প্রশাসনের সহযোগীতায় নৌকা প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখে আওয়ামী লীগের লোকজন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়া সেন গুপ্তা বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। কারচুপির অভিযোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জন ও ফলাফল প্রত্যাখান করে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে পঞ্চম সংসদে গনতন্ত্রী পার্টি, সপ্তম সংসদে জাতীয় পার্টি, অষ্টম, নবম সংসদে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ – ২ সংসদীয় আসনে ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৬৪.০১% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৫৭.৮৩%, বিএনপি ২.৫০%, জাতীয় পাটি ৩৫.৬১% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ৪.০৬% ভোট পায়।
১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৮৩.৩৫% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪৮.২৭%, বিএনপি ১.৫৪% জাতীয় পাটি ৪৮.৬৮%, জামায়াত ইসলামী ০.৯১% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ০.৬০% ভোট পায়।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৭৯.৭৮% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৫৫.০১%, ৪ দলীয় জোট ৪৪.২০%, জাতীয় পাটি ০.৭৯% ভোট পায়।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৮৮.৫৩% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ১৪ দলীয় জোট ৫৪.৮৬%, ৪ দলীয় জোট ৪৪.৭০% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ০.৪৪% ভোট পায়।
তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।এই সংসদীয় আসনটিতে প্রচুর সংখ্যালঘু হিন্দু ভোটার রয়েছে। তারাই নির্ধারণ করে জয় পরাজয়। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর এ আসন থেকে থেকে প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৮ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রত্যেকবারই দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকতো মূলত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও নাছির উদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে। তবে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নাছির উদ্দিন চৌধুরীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে নাছির উদ্দিন বিএনপিতে যোগদান করেন।
এবার বিএনপি থেকে সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরীর মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভবনা বেশি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন। এ ছাড়া মনোনয়ন দৌড়ে আছেন সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল। তার সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সখ্যতা রয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন চৌধুরী জাবেদ, যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার আব্দুল মজিদ তাহের মনোনয়ন চাইবেন।
জামায়াত ইসলামী ইতোমধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট শিশির মনিরকে মনোনয়ন দিয়েছে। তিনি এলাকা প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। যাচ্ছেন, পাড়ায় পাড়ায়, মসজিদ মন্দিরে। তার টার্গেট হিন্দু ভোটার। তাদের আস্থা অর্জন করতে গিয়ে দুর্গা পূজা পরির্দশনে গিয়ে মুসলমানদের ‘রোজা ও হিন্দুদের পূজা একই’ বলে মন্তব্য করেছেন।
সুনামগঞ্জ -২ সংসদীয় আসনে শিশির মনির প্রার্থী হিসাবে নবাগত। তার ভোটের রাজনীতির অভিজ্ঞতা নেই। আগে কখনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। এলাকার মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নয়। তিনি এখনো গণমানুষের নেতা হয়ে ওঠতে পারেনি। তাছাড়া জামায়াত ইসলামী সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী নয়। তার বিপরীতে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী নাছির উদ্দিন চৌধুরী বেশ জনপ্রিয়। তাছাড়া বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে বেশ শক্তিশালী। উদাহারণ হিসাবে বলা যায় সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ইসলামীর প্রার্থী পেয়েছেন ০.৯১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ এক শতাংশের কম। এই অবস্থায় জামায়াত ইসলামীর প্রার্থী হিসাবে শিশির মনির নির্বাচনে প্রতিদ্বিন্দ্বিতা করলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে বলে মনে করেন এলাকার ভোটারা!
![]()
