বিএনএ, ঢাকা : চট্টগ্রামের বিউটি পালার ব্যবসায়ি থাইল্যান্ডের নাগরিক লুসি ও জাতীয় দলের সাবেক উইকেট কিপার শফিকুল হক হীরার মেয়ে ও প্রয়াত জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র স্ত্রী সামিরা হক। সালমান শাহ মৃত্যুর ২৮ বছর পর গত বছর সেপ্টেম্বরে একটি বেসরকারি চ্যানেলের সঙ্গে আলাপ কালে যে রিজভীর কথা বলেছেন, আদালতে তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সালমান শাহ’র আত্মহত্যা মামলাটি ২৯ বছর পর হত্যা মামলায় রূপ নিল।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন গার্ডেনের ভাড়া বাসায় ঢাকাই সিনেমার দর্শকপ্রিয় চিত্রনায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহর মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় রমনা থানায় মামলা হয়। সেই মামলায় তিন ধরনের তদন্ত হয়। সব তদন্ত শেষে আত্মহত্যা হিসেবে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দিয়ে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী মামলাটি রিভিশনের আবেদন করেন। দীর্ঘ প্রায় চার বছর পর গত ২০ অক্টোবর রিভিশন আবেদন মঞ্জুর হয়। অপমৃত্যুর মামলাটিকে হত্যা মামলা হিসেবে অভিযোগ গ্রহণের নির্দেশ দেন আদালত।
অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপ নেওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে দীর্ঘ ২৮ বছর আগে ১৯৯৭ সালে আসামি রেজভীর দেওয়া একটি জবানবন্দি।
সালমান শাহ হত্যার মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ সালমান শাহর ভাই বিল্টুকে অপহরণের পরিকল্পনা করে ডন ও ডেভিড। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই গ্রেফতার হন রিজভী আহমেদ।
ওই বছর ২৪ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। স্বীকারোক্তিতে তিনি জানান, সালমান শাহকে খুনের জন্য সামিরার মা ডনকে ১২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেন। হত্যার আগে ৬ লাখ ও পরে ৬ লাখ। তিনি হত্যার আগে ৬ লাখ টাকা দেন।
রিজভী জবানবন্দিতে বলেন, ৯০ দশকের প্রথম দিকে রিজভী মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন এবং ছবি দেখার জন্য এফডিসিতে যেতেন। একসময় অভিনেতা ডনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। পরে ডেভিড, ফারুকের সঙ্গেও তার পরিচয় হয়। ডন সালমান শাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সালমানের স্ত্রী সামিরার সঙ্গে ডনের গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং দৈহিক সম্পর্কও ছিল। সামিরার মায়ের সঙ্গে চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গোপন ও দৈহিক সম্পর্ক ছিল।
১৯৯৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর দুপুরে গুলিস্তানের বারে সালমান শাহকে হত্যার প্রস্তুতি নিয়ে রিজভী এফডিসিতে যান। ডনকে না পেয়ে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। পরে ডনকে পান। রাত ৮টায় ডন, ডেভিড, ফারুক, জাভেদ ও রিজভী গুলিস্তানের কাছে একটা বারে যান। সেখানে টেলিফোনে আরও দুই জন, ছাত্তার ও সাজুকে আসতে বলেন। তারা কিছুক্ষণ পরে আসেন। ফারুক ২ লাখ টাকা বের করে বলেন, সামিরার মা টাকা দিয়েছেন। কিন্তু ২ লাখ টাকা পেয়ে ডনের সঙ্গে ফারুকের বাগবিতণ্ডা হয়। ফারুক ২০-২৫ মিনিট পরে আরও ৪ লাখ টাকা নিয়ে আসেন।
গুলিস্তানের বারে ডন প্লাস্টিকের দড়ি দুই টুকরো করেন। এক টুকরা নিজের মাজায় বেঁধে কালো জ্যাকেট গায়ে দেয়। বাকি অর্ধেক রশি ফারুকের কাছে দেন। টাকা, সিরিঞ্জ, রিভলভার ইত্যাদি তারা গুছিয়ে নেন। সামিরার মা ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই দুজনে মিলেই সালমানকে শেষ করার জন্য ডন ও ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
ওই দিন গুলিস্তানের বার থেকে তারা এফডিসিতে যান। সেখানে শুটিং শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত আড়াইটার সময় বের হন। রিজভী ডনকে জিজ্ঞেস করেন, আমি চলে যাবো? ডন তাদের সঙ্গে যেতে বলেন। পরে গাড়ি ড্রাইভ করে ইস্কাটনের সালমানের বাসায় যায় ডন-ডেভিড ও ফারুক।
রিজভী আরও বলেন সালমানের বাসায় লিফটে ওঠার আগেই রুবী নামে একজন মেয়ের দরজায় নক করেন ডন। রুবী নাইটি পড়া অবস্থায় দরজা খোলেন ও বলে, ‘তোমরা এসছো।’ ডন রুবীকে বলেন, ‘আজিজ ভাই কোথায়’? বাথরুম থেকে আজিজ ভাই বের হয়ে আসেন এবং রুবি ছাড়া সবাই একত্রে লিফটে উঠেন। আজিজ ভাই চার তলায় নেমে যান এবং অন্যরা ১১ তলায় নেমে সালমানের বাসায় যান। সালমানের দরজা আগে থেকেই চাপানো ছিল। দরজা খুলেই দেখা যায়, সালমান বেডরুমে শুয়ে আছেন, সামিরা সেখানে নাই। ডন, ডেভিড, জাভেদ, ফারুক সালমানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ফারুক তার পকেট থেকে ক্লোলোফরমের শিশি বের করে সামিরাকে দেন। সামিরা সেটা দিয়ে সালমানের নাকের ওপর চেপে ধরেন। ডন সালমানের বুকের ওপর বসেন। ফারুককে বলেন, আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে ডাক। ফারুক বাইরে গিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে আসেন।
আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে রিজভী বলেন. সামিরার মা ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে আসেন। তখন ধস্তাধস্তি হচ্ছিল। সালমানের খুব শক্তি ছিল, ইনজেকশন দেওয়া যাচ্ছিল না। তখন সবাই মিলে সালমানকে ড্রেসিং রুমে নিয়ে পা বাঁধেন। আজিজ ভাই ডনকে ইনজেকশন দিতে বলেন। সিরিঞ্জটাতে কোনও ওষুধ বা কিছু ছিল না। সামিরা পুশ করেন, তার মা সাহায্য করে। পরে সালমান নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
ইনজেকশন পুশ করার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সালমান শাহের ঘাড়ের ওপর ফ্যান ছুঁড়ে মারেন। ড্রেসিং রুমে একটা মই ছিল। আজিজ মোহাম্মদ ভাই রিজভীকে মই আনতে বলেন। মই আনার পর ডনের কোমরের দড়ি নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজেই মই দিয়ে উঠে দড়িটিকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে বাঁধেন। রিজভী, সামিরা, তার মা সাহায্য করেন।
পরে সালমানের পায়ে বাঁধা রশি খুলে বুকের ওপর উঠে গলায় চাপ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে, নিশ্বাস নেই। রশিটা কিছুটা ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে দেখানো যায়, লাশটাকে ঝুলানো থেকে খোলা হয়েছে। এর আগে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘরে ঢুকেই কাজের মেয়ে ও একটা ছেলেকে আলাদা আলাদাভাবে ড্রয়িং রুমে ও বাথরুমে আটকে রাখা হয়।
রিজভী আরও বলেন সালমান সুইসাইড করেছে এটা দেখানোর জন্য তেল মালিশ করা হয়। কাপড় ভিজিয়ে শরীরে রাখা হয়। পরে পেছনের গেট দিয়ে সবাই বেরিয়ে যান। গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়েন। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে নামার পর ফজরের আজান হয়। পরে রিজভী ফরিদপুর চলে যান।
প্রসঙ্গত, সালমান শাহর ভাইকে অপহরণ করতে গিয়ে গ্রেফতার রিজভী পরের বছর ৪ জুলাই ডন ও ডেভিড রিজভীদের ফরিদপুরের বাড়িতে যান। পরে ফরিদপুরের একটা আবাসিক হোটেল সুগন্ধায় বসে আলাপ করেন।
পরিকল্পনা হয়, রিজভী প্রয়াত চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরের ছেলে লেনিন সেজে সালমানের বাবা-মার বাসায় যাবেন এবং সালমানের ছোট ভাই বিল্টুকে অপহরণ করবেন। সালমানের হত্যা মামলা প্রত্যাহার করতে তার বাবা মাকে চাপ সৃষ্টি করবেন। আলমগীর কবির রিজভীর মামা। আলমগীরের মৃত্যুর আগে আগে লেনিন সালমানদের বাসায় বেশ কিছু দিন ছিলেন।
১৯৯৭ সালের ১৯ই জুলাই সালমানের বাবা-মার বাসায় যান রিজভী। তাদের পরিকল্পনা ছিল, বিকাল ৫টায় ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বিশ্বরোডের রেল ক্রসিংয়ের কাছে বিল্টুকে নিয়ে যাবেন এবং বাসায় ফিরবেন। ডন, ফারুক, জাভেদ সবাই তাদের ফলো করবেন। বাসা চিনে আসবেন। রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে রিজভী দরজা খুলে দিলে বিল্টুকে অপহরণ করে সবাই চলে যাবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ই জুলাই বাড়ি থেকে রওনা দেন রিজভী। পরের দিন ঢাকায় পৌঁছে বিল্টুদের বাসায় যান। লেনিন বলে পরিচয় দিয়ে বাসায় গেলে সালমান শাহর বাবা-মা রিজভীকে সন্দেহ করে পুলিশে দেন। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তার পরই মাত্র ৪ বছরে ২৭ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে ঝড় তোলা সালমান শাহ হত্যা মামলার মোড় ঘুরে যায়। আর অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলা রূপ নিতে সময় লাগে— ২৯ বছর!
বিএনএনিউজ/ সৈয়দ সাকিব/এইচ.এম।
![]()
