।। বাবর মুনাফ ।।
২০২৪ সালের ২৩ মে গণভবনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে এমন মন্তব্য করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মন্তব্য দেওয়ার তিন মাস তের দিনের মাথায় ছাত্র জনতার গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের ৮ মাস পর সম্প্রতি গৃহযুদ্ধের মধ্যে থাকা মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য শর্তসাপেক্ষে ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এমনটি জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তার এই বক্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার কিসের ভিত্তিতে এবং কোন প্রক্রিয়ায় ‘মানবিক করিডোর’ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার মন্তব্য সত্যি হচ্ছে কীনা সেটা নিয়েও দেশজুড়ে গুজব- গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, প্রভাবশালী পশ্চিমা কয়েকটি দেশ দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশের কাছে এমন একটি করিডোরের পরামর্শ বা প্রস্তাব দিয়ে আসলেও রাজনৈতিক সরকারগুলো ভূ-রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় তাতে কখনো সায় দেয়নি।
ভূ- রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্নার সঙ্গে তার ‘মানচিত্র’ অনুষ্ঠানে এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, রাখাইনে এই মানবিক করিডোরের আড়ালে লুকিয়ে আছে ইসরায়েলের এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। বদলে যেতে পারে দেশের মানচিত্র!

রাখাইনকে করিডোর দেওয়ার পুস্কার হিসাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস যদি জাতিসংঘের মহাসচিব হন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, বলেন নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
‘মানবিক করিডোর’ দেয়ার বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন “সরকারের উচিত ছিল, দায়িত্ব ছিল এই বিষয়টা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা,”। এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিএনপি মহাসচিব।
সোমবার রাতে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা একমত হয়েছে যে, গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোর জন্য ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার মতো নীতিগত সিদ্ধান্ত কোনো অনির্বাচিত সরকার নিতে পারে না। এর সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রশ্ন জড়িত। তাই এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোসহ জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা করা উচিত। সেটা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এই ইস্যুতে সরকারকে চিঠি দেবে বিএনপি। প্রয়োজনে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। প্রয়োজনে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করবে সরকারকে এমন পরিকল্পনা থেকে সরিয়ে আনতে। বিএনপি সরকারকে সতর্ক করবে যে এমন পদক্ষেপ বাংলাদেশকে ফিলিস্তিনের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে।
‘মানবিক করিডরে’র বিষয়ে সরকারের কাছে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দাবি করেছে জামায়াতে ইসলামী। “রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডোরের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট করা দরকার। কারণ এর সঙ্গে অনেক নিরাপত্তা বিষয় জড়িত থাকতে পারে,” সোমবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের পোস্টে লিখেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান।
একই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা।”অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তামূলক নীতি গ্রহণে অবশ্যই ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত,” নিজের ফেরিভায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ।
তিনি আরও বলেন, “আলোচনা ব্যতিত এ ধরনের সিদ্ধান্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইনটেগ্রিটি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।”
মঙ্গলবার দুপুরে করিডোর ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক।
“বাংলাদেশকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলাম কোনোভাবেই এটি সমর্থন করে না। এর নিন্দা জানাই। আমরা এর প্রতিবাদ জানাবো বলেন, মামুনুল হক।
এদিকে, গত রোরবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যে ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজে’র বিষয়ে নীতিগত সম্মতির কথা উল্লেখ করা হলেও বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার ভিন্ন ব্যাখ্যা তুলে ধরছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি বলেছেন, “আমরা এটা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে সরকার তথাকথিত ‘মানবিক করিডোর ‘ নিয়ে জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি। রাখাইন রাজ্যে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সাহায্য দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে রাজি হবে, এটাই আমাদের অবস্থান,”।
এদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানের অফিস থেকে জানানো হয়েছে “আমরা মিয়ানমারের মাটিতে ঢুকবো না। যতটুক সহায়তা দেয়ার বাংলাদেশের ভেতরেই দেয়া হবে,”। এছাড়া দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, আরাকান বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত বছরের ১৪ ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শিরোনামের একটি আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি দেয়া বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের একটি ধারণা দিয়েছিলেন।
ওই আলোচনা সভাতেই সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা–বাণিজ্য করা ও মানবিক করিডোর খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এরপর মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মন্তব্য করে।
এর কয়েকদিন পরেই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় আসেন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য একটি করিডোর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ।
সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। একদিকে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্র দেশগুলোর চাপ; অন্যদিকে দেশের নিরাপত্তার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থা দাড়িয়েছে, শ্যাম রাখি না কূল রাখি।
বিএনএনিউজ/ সাকিব