কিছু কিছু সরকারি কর্মচারী যারা ইংরেজদের কাছ থেকে শিখেছে তারা এর পিছনে আছে । আমি তাদের জানি, যদি বেঁচে থাকি তবে এর বিচার একদিন হবে, আর যদি মরে যাই তবে সহকর্মীদের বলে যাবো তাদের নাম । কঠোর সাজা যেন দেওয়া হয়। জীবনে যেন না ভোলে। সাবধান করে দিয়ে যাবো- ক্ষমতায় গেলে এরাই সবার পূর্বে এসে আনুগত্য জানাবে এবং প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাবে।
খবরের কাগজ আজ আর এল না। সাংবাদিকরা প্রতিবাদ দিবস পালন করছে নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে এবং মানিক ভাই ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে । কোনো কাগজই আসে নাই ।
দিনটা মেঘলা, সূর্যের মুখ দেখলাম না। তবে বৃষ্টি হয় নাই। সন্ধ্যার পরে ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়। আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । রাত দু’টায় এক পাগল আজও ক্ষেপে গিয়েছিল। তবে ঘুম বেশি নষ্ট করতে পারে নাই ।
২২শে জুন ১৯৬৬ ॥ বুধবার
ভোর থেকে ভীষণভাবে বৃষ্টি নেমেছে। থামবার নামও নিতেছে না। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে যেয়ে দেখি ডিম দিয়েছে একটা। যতগুলি ডিম আমাকে এ পর্যন্ত দিয়েছে সবই নষ্ট। যাদের ডিমের কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয় তারা বাজার থেকে পচা ডিম কিনে আনে। বাধা দেবে কে? মুখতো বন্ধ । কন্ট্রাক্টর সাহেব নিশ্চয়ই জানে কেমন করে মুখ বন্ধ করতে হয়! দোষ কাকে দিব? সমস্ত দেশটায় যাহা চলছে এখানেও সেই একই অবস্থা। দেখার লোকের অভাব। কেহ ভাল হতে চেষ্টা করলে তার সমূহ বিপদ ।
একটা ঘটনা আমার জানা আছে। এক থানায় একজন কর্মচারী খুব সৎ ছিলেন। ঘুষ তিনি খেতেন না। কেহ ঘুষ নিক তিনি তাহাও চাইতেন না, সকলে তাকে বোকা বলতে শুরু করে ছোট থেকে বড় পর্যন্ত। একদিন তার এক সহকর্মী তাকে বলেছিল, সাধু হলে চাকরি থাকবে না। বড় সাহেবের কোটা তাকে না দিলে খতম করে দিবে। তিনি তাহা শুনলেন না। বললেন, ঘুষ আমি খাব না, আর ঘুষ দিবও না। সত্যই ভদ্রলোক ঘুষ খেতেন না । কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল ঘুষ খাওয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে । তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই মিথ্যা মামলায় তাকে চাকরি হারিয়ে কোর্টে আসামি হতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকে তিনি মুক্তি পান, চাকরি আর করেন নাই। সকল জায়গায়ই একই অবস্থা আজকাল, এখন অনেক বেশি। কাহাকেও ভয় করে না। সোজাসুজিই এসব চলছে।
কারাগারের অবস্থা বাইরে যারা আছেন বুঝবেন না। অনেক কর্মচারী আছে যারা এক পয়সাও ঘুষ খায় না। এমন কি জেলের কোনো জিনিসও গ্রহণ করেন না । আমি অনেককে জানি। তাদের চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নাই । যাক, আমার জিনিসপত্র মন্দ নাই, আমার ব্যাপারে সকলেরই সহানুভূতি আছে । আমাকে ভাল জিনিস দিতে পারলে এরা খুশিই হয়। ডিম এই সময় একটু বেশিই নষ্ট হয়। চেষ্টা নিশ্চয়ই তারা করেন, ভাল ডিম পায় না কি করবে? আমি যাহা চাই তাহাই তারা দিতে চেষ্টা করে ।
সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৩, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
কারাগারের রোজনামচা: পর্ব-৭৯
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী