তবে আসামি হওয়ার পরে ধরা না দিয়ে মামলার খরচ যোগাড় করার জন্য তিনটা ডাকাতি করেছে । তবে যে ডাকাতি মামলায় তার জেল হয়েছে তাতে তার কোনো দোষ নাই, কারণ সে ঐ ডাকাতির দলে ছিল না। আরও বলল, ‘আর ডাকাতি করব না। কোনোমতে যে কয়দিন বেঁচে আছি, ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে পারলেই হলো । তবে ভয় হয় টাকা দিতে না পারলে অন্য কোনো মামলায় আসামি না হয়ে পড়ি যাই হোক না কেন, আর ডাকাতি করব না ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে বাস করতে চাই।’
১৫ই জুন ১৯৬৬ ॥ বুধবার
আজ আমার ছেলেমেয়েরা আসতেও পারে, কারণ ১৫ দিন হয়ে যায় । আমিও একটা দরখাস্ত করেছি, মায়ের অবস্থা জানবার জন্য তাড়াতাড়ি আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই অনুমতি না আসা পর্যন্ত তো সঠিক খবর পাব না । চিন্তা না করতে চাইলেও চিন্তা আসে ।
আমার বাবুর্চি একটা কবুতরের বাচ্চা পালে । তাকে আদর করে কোলে নিয়ে বেড়াই । এখনও কাপড়ের ছোট্ট থলিয়া বানাইয়া তার ভিতর ভিজা চাউল দিয়ে তারপর একটা ফুটো করে খাবার খাওয়াতে হয় । এখন একটু একটু উড়তে শিখেছে । চুপচাপ কিছু সময় তারপর দেয় ছুট। একেবারে পাকের ঘরের দিকে ছুটলো । মানে আমাকে আর ধরতে হলো না বাচ্চাটা বাবুর্চিকে দেখলে মনে করে সেই বোধ হয় তার সব কিছু ।
আজ বাইরে অনেক সময় বসে রইলাম। অনেক কথা মনে আসে! নানা বিষয়ের অনেক কথা । বরিশালের মি. চিত্তসূতার ও পাবনার রণেশ মৈত্র আমার সামনেই বিশ সেলে আছেন । আগে মাঝে মাঝে দরজা খুলতো, আজ থেকে কড়া হুকুম, দরজা খোলাই হবে না ।
কি ভীষণ দুরবস্থা! যদিও ভিতরে সামান্য জায়গা আছে তবুও মন দেখতে চায় বাহিরটাকে । তাই মনের উপর এই ভীষণ অত্যাচার বন্দি লোকগুলি অন্ধ
হয়ে যাবে, না হয় স্বাস্থ্য একবারে ভেঙে যাবে বাইরে যেয়ে যেন আর কোনো কাজ করতে না পারে—এটাই স্বৈরাচারী সরকারের উদ্দেশ্য । আমি দূর থেকে অনেকক্ষণ দেখলাম, দরজা খোলা হলো না । পরে খবর নিয়ে জানলাম কড়া হুকুম, জমাদার সিপাহির চাকরি থাকবে না । আমার সাথে যেন কোনোমতে কথা না বলতে পারে । কথা তো আমরা বলতেও পারি না। দরজা খুললে দরজার কাছে দাঁড়ালে দূর থেকে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানাতে পারি । এর বেশি তো আর না । আমার অবস্থা হয়েছে, ‘পর্দানসিন জানানা’র মতো, কেউ আমাকে দেখতেও পারবে না, আমিও কাউকে দেখতে পারব না । কেউ কথা বলতে পারবে না, আমিও পারব না।’
সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৯০-৯১, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
কারাগারের রোজনামচা : পর্ব-৬০
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী