।।শামীমা চৌধুরী শাম্মী।।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন চট্টগ্রামের আবাসন পরিদপ্তরে সরকারি বাসা বরাদ্দে সিন্ডিকেট করে ঘুষের সাম্রাজ্য কায়েম করছে একটি চক্র। এই চক্রের প্রধান হোতা আর এসব ঘুষের মূলহোতা হিসেবে কাজ করছেন, চট্টগ্রাম আবাসন অফিসের প্রধান সহকারী মো. মোজাফফর, সাথে আছে ফিরোজ ও প্রদীপ। এই চক্রটিকে ঘুষ দিলে অফিসারদের জন্য নির্ধারিত বাসা বরাদ্দ পায় পিয়ন। আর ঘুষ না দিলে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি বাসা বরাদ্দে সুবিধার্থে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল একটি গেজেট প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার। গেজেট অনুযায়ী গ্রেড ১৮,১৯ ও ২০ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য এ টাইপ, ১৬, ১৭ ও ১৮ এর জন্য বি টাইপ, ১৪, ১৫ ও ১৬ এর জন্য সি-২ টাইপ, ১২, ১৩ ও ১৪ এর জন্য সি-১ টাইপ, ১০, ১১ ও ১২ এর জন্য ডি-২ টাইপ, ৭, ৮ ও ৯ এর জন্য ডি-১ টাইপ, ই টাইপ এর জন্য গ্রেড ৬ থেকে উপরের কর্মকর্তা, এফ টাইপ গ্রেড ৫ ও এর উপরের গ্রেডের কর্মকর্তা/ উপ সচিব এর জন্য, গ্রেড ৩ বা যুগ্নসচিব এর উপরের কর্মকর্তাদের জন্য সুপিরিয়র টাইপের বাসা বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর জেলা প্রসাশকের কার্যালয়ে জেলা আবাসন বোর্ডের সভায় ২২২টি বাসা বরাদ্দে বাংলাদেশ গেজেটটি অনুসরণ করা হয়নি।
এসব অনিয়ম নিয়ে চট্টগ্রাম আবাসন পরিদপ্তরের উপ-পরিচালকসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে, গতবছরের ২৯ অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন অফিসের হিসাব সহকারী মো. আলা উদ্দীন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, সরকারি আবাসন পরিদপ্তর, চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মুনতাসির জাহান, প্রধান সহকারী মো. মোজাফফর হোসেন, উচ্চমান সহকারী মো. দেলওয়ার হোসেন, রাজীব বড়ুয়া, উচ্চমান সহকারী মো. আরিফুর রহমান, মো. ফিরোজ কবির প্রধান, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর বকুল জ্যোতি চাকমা, সহকারী হিসাব রক্ষক প্রদীপ কুমার রায় ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সেন্টলী চাকমার যোগসাজশে ২৮ জন ব্যক্তিকে সরকারি গেজেট অনুসরণ না করে ৭৯ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধভাবে ২য় শ্রেণির কর্মচারীকে ১ম শ্রেণির সরকারি বাসা, ৩য় শ্রেণির কর্মচারীকে ২য় শ্রেণির বাসা এবং ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীকে ২য় শ্রেণির বাসা বরাদ্দ প্রদান করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, হালিশহর আহমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (১০ম গ্রেড) মোজাম্মেল হক তিনি ডি-৭/ ডি নাফ সিজিএস, সুলতান আল নাহিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার শাদাত (১০ম গ্রেড) ডি-৭/১সি নাফ সিজিএস এর বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে এই বাসাগুলো ৭,৮,৯ গ্রেডের জন্য বরাদ্দ দেয়ার কথা। একইভাবে আগ্রাবাদ সরকারি কলোনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (১৩ তম গ্রেড) তিনি ডি-৭/১৭ নাফ সিজিএস, ডবলমুরিং থানা শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী প্রতাপ কান্তি দস্তিদার (১৬ তম গ্রেড) সে ডি-২/১সি হালদা সিজিএস, কর অফিসের সাঁট মুদ্রাক্ষরিক সাদ্দাম হোসেন (১৪তম) ডি-২/২২ হালদা, ফারহানা আক্তার (১৪তম) ডি-২/১ হালদা,কর অঞ্চল ৪ এর সার্কেল ৮১ এর উচ্চমান সহকারী আমির হোসেন (১৪তম) ডি-২/৯ টাইপের বাসা বরাদ্দ পেয়েছে। যা গেজেটের সাথে সাংঘর্ষিক।
এসব বাসা বরাদ্দে ৩ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তুলেছেন। এছাড়াও শেরশাহ কলোনীতে সি-২/কে, সি- ১/ডি, সি- ১/সি, সি- ১/ এইচ সহ অনেক বাসা ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা ঘুষের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। একইভাবে বাসা বরাদ্দ ক্রমিকের ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬১, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০, ৮১, ৮৬, ৯৩, ৯৬, ৯৭ নং বাসাগুলো ঘুষের বিনিময়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এসব বিষয় অভিযোগের তদন্ত করছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাহিদ উল মোস্তাক। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করা হয়েছে তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানা যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপন ও সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের এক আদেশে সহকারী পরিচালক বিলাল হোসাইন, উপ-পরিচালক রাশেদ আহাম্মেদ সাদী ও সহকারী হিসাবরক্ষক মো. নজরুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ ব্যপারে আবাসন পরিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মুনতাসির জাহান বলেন, ”বাসা বরাদ্দ দিয়ে থাকেন জেলা আবাসন বোর্ড। যেটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। তিনি ছাড়াও আরো ৯ জন সদস্য থাকেন। সরকারী নিয়ম মেনেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে বাসা বরাদ্দের কোন এখতিয়ার আবাসন পরিদপ্তরের নেই।”
গতবছরের একটি অভিযোগের শুনানিতে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা সবাই শুনানিতে গিয়েছি কিন্তু আবেদনকারী আসেনি। আর যে ব্যক্তি অভিযোগ দিয়েছেন সেই আলা উদ্দীন নামের কোন ব্যক্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগকারি আলাউদ্দীনের সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা কথা বলেছে, দেখাও করেছে। কিন্তু গত ২৯ সেপ্টেম্বরের শুনানিতে তিনি উপস্থিত হননি। বাসা বরাদ্দ সিন্ডিকেট ভয়ভীতি ও বাসা বরাদ্দ দেয়ার টোপ দিয়ে তাকে ম্যানেজ করে নিয়েছে।
এব্যপারে জানতে অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব নাহিদ উল মোস্তাকের মোবাইলে কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, কোন কর্মচারী নিয়ম অনুযায়ী সরকারি বাসা বরাদ্দের জন্য আবেদন করলেও তাদের সিন্ডিকেটকে যারা ঘুষ দেন শুধুমাত্র তারাই সরকারি বাসা বরাদ্দ পেয়ে থাকেন।
শেরশাহ কলোনির সি-১/ডি বাসাটি হাবিব নামে একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীকে না দিয়ে টাকার বিনিময়ে ৪র্থ শ্রেণির পুলিশ কনস্টেবলকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, শেরশাহ সরকারি কলোনির সি টাইপের ১ নং ভবনটি মেজিস্ট্রেটদের থাকার জন্য করা হয়েছিল। উনারা উক্ত ভবনে না উঠায় পরবর্তীতে ভবনটিতে বিভিন্ন দফতর এর লোককে বাসা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। কিন্তু বর্তমানে শেরশাহ সরকারি কলোনিতে ৮/১০ টি বাসা ছাড়া বাকি সকল বাসাই পুলিশ কনস্টেবল, হাবিলদার ও এএসআইদের দখলে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে বিভিন্ন স্হাপনা করা সহ, নিজেরা অবৈধভাবে বড় গাজী পানির ট্যাংক স্হাপন সহ বাকিদের থাকার সমস্যা সৃষ্টি করার পাশাপাশি কলোনির পরিবেশ নষ্ট করছে।
পুলিশের হাবিলদার জাহিদ শেরশাহ কলোনির সি-১/বি বাসাটি বরাদ্দ নিয়ে থাকছে। সে ভবনটির চতুর্পাশে সিমগাছ, লাউগাছ, পেপেগাছ সহ জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে। এমনকি সে রাস্তা কেটেও তার বাগানকে বড় করেছে। তার এই কর্মকান্ডের কারনে গতবার শেরশাহ সরকারি কলোনিতে বসবাসকারি অনেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে একজন মারাও যান।
অন্যদিকে শেরশাহ সরকারি কলোনির বিভিন্ন পরিত্যক্ত বাসাগুলো ভাড়া দিয়ে এবং খালি জায়গাগুলোতে বিভিন্ন দোকানপাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া তোলা হচ্ছে। এর সঙ্গে শেরশাহ সরকারি কলোনির সভাপতি-সেক্রেটারি এবং আবাসন বিভাগের মোজাফফর ও স্হানীয় কিছু নেতৃস্হানীয় লোকজন জড়িত।
উল্লেখ্য শেরশাহ সরকারি কলোনির বর্তমান কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি-সেক্রেটারিসহ অন্যান্য সদস্যরা কলোনিতে বসবাসকারিদের ভোটে নির্বাচিত নন। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে নিজেরা নিজেরা সভাপতি-সেক্রেটারিসহ বিভিন্ন পছন্দের লোক নিয়ে কমিটি করছেন।
এবিষয়ে জানতে, চট্টগ্রাম আবাসন পরিদপ্তরের প্রধান সহকারী মো. মোজাফফরের অফিসে গিয়ে এবং মোবাইলে কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
![]()
