বিএনএ, ঢাকা: স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে যুদ্ধরত অনেক দেশেই বেসামরিক লোকদের কাছে মানবিক সহায়তা প্রদানে মানবিক করিডোর স্থাপন ও ব্যবহার করা হয়েছে। এসবের কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃপ্রণোদিত আলোচনার মাধ্যমে, কোনো কোনোটি তৃতীয় পক্ষ বিশেষত জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে। উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত ফলাফল ভালো হয়নি।

আর্মেনিয়া-আজারবাইজান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কঙ্গো কিংবা সিরিয়া– কোথাও মানবিক করিডোর সফল হয়নি। সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়াতেও জাতিসংঘ প্রস্তাবিত মানবিক করিডোরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
অনিবার্যভাবেই সামরিক নানা বিষয় যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যে এমনটি ঘটবে না– সে ব্যাপারে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। কারণ আরাকান রাজ্যে এ ধরনের করিডোর মিয়ানমার সহজভাবে গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। ভূরাজনৈতিক কারণে এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীনের দীর্ঘদিনের স্বার্থ-সংঘাত সুবিদিত। সঙ্গে রয়েছে ভারত ও রাশিয়ার স্বার্থও। বাংলাদেশ রাখাইনে যে মানবিক করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে বাংলাদেশ নিরাপত্তা ঝুকিতে পড়বে। এমনটাই মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল হক।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের সময় বেসামরিক মানুষদের সাহায্য করার জন্য লাচিন করিডোর স্থাপিত হয়েছিল। এটি নাগোর্নো-কারাবাখের আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক করিডোর বা ‘জীবনরেখা’ হিসেবে বিবেচিত ছিল। শুরুতে কিছুদিন ভালো চললেও বছর দুয়েকের মাঝেই করিডোরটি আজারবাইজান বন্ধ করে দেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, প্রতিপক্ষ এটিকে সামরিক সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ‘অবৈধ’ পরিবহনের কাজে ব্যবহার করছিল; যদিও আর্মেনিয়া ও তার মিত্র প্রজাতন্ত্রগুলো এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে আক্রমণের পর আজারবাইজানি বাহিনী পুরো নাগোর্নো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফলে নাগোর্নো-কারাবাখের প্রায় সব আর্মেনীয় বাসিন্দা লাচিন করিডোর দিয়ে আর্মেনিয়ায় চলে যায়। এভাবেই একটি মানবিক করিডোরের অমানবিক মৃত্যু ঘটে।
বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় মানবিক করিডোরের ইতিহাস আরও রক্তাক্ত। সেখানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মানবিক করিডোর।
১৯৯৩ সালের ১৬ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে স্রেব্রেনিকা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে একই বছরের ৬ ই মে নিরাপত্তা পরিষদের ৮২৪ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ৬টি মানবিক করিডোর ঘোষণা করা হয়। এগুলোকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী ইউনিটের সুরক্ষাধীন রাখা হয়। এটা জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের একটি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
কারণ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মতো যুদ্ধক্ষেত্রে এই নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত করা হবে, সেটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা ছিল না। ফলে প্রস্তাবটি পরে জটিল ও কঠিন কূটনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। কারণ এর পক্ষে ভোট দেওয়া রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক কারণে নিরাপদ এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক ছিল না। এ অবস্থায় ১৯৯৫ সাল নাগাদ জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকাগুলোতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে এবং স্রেব্রেনিকা গণহত্যার ক্ষেত্র তৈরি করে। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার একটি।
আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী এবং জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। সেখানেও জাতিসংঘের প্রস্তাবমতে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডোর খোলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দেশটির সমস্যা সমাধানে এই পদক্ষেপও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এমন মনে করার অবস্থা এখনও সৃষ্টি হয়নি।
২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ও বিভিন্ন সময় নিরাপদ অঞ্চল, উত্তেজনা কমানোর অঞ্চল বা নো-ফ্লাই জোন প্রস্তাব বা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই তেমন কাজে লাগেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। সিরিয়ার বর্তমান অবস্থাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বস্তুত বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে যেসব জায়গায় ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো শেষ পর্যন্ত শুধু মানবিক করিডোরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত বছর ১১ই নভেম্বর আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন থেকেই রাখাইনে মানবিক করিডোরের বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছিল মার্কিন প্রশাসনে। এরপর মার্কিন নাগরিক প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান গত ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শীর্ষক এক সেমিনারে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের একটি ধারণা দিয়েছিলেন। ওই সেমিনারে সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি ও মানবিক করিডোর খোলার প্রস্তাব রাখেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সেন্টমার্টিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ পড়েছে একাত্তর সালের স্বাধীনতার আগে থেকে। কিন্তু ক্ষেত্র প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতা থাকাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিনের অদূরে একটি বেইজ স্টেশন স্থাপনে বেশ কয়েক দফা জোরালো চেষ্টা করে। কিন্তু চীন ও ভারতের বিরাগভাজন হতে পারে এমন শঙ্কা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব নাকচ করে দেয় শেখ হাসিনা সরকার। তারপর থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকে এবং ছাত্র জনতার আন্দোলনে জাতিসংঘ ও মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্র এই আন্দোলনে ফুয়েল জোগায় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালা বদলের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। কিন্তু গত ১৪ই মে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসার পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
গত ১৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টই বলেছিলেন– ‘মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। সর্বশেষ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত ২৭শে এপ্রিল এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে করিডোরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডোরের নামে মূলত: মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্র একটি সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। আর সেই কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর ভর করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ায় অনিদিষ্টকাল ক্ষমতায় আসীন থাকতে চায়। তারই ধারাবাহিকতায় ড. ইউসূস সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় রাখতে ক্যাম্পেইন করছে সরকারের কাছাকাছি থাকা রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারি কিছু গোষ্ঠী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের পদ থেকে বিদায় নেয়ার পর জাতিসংঘের মহাসচিবের পদে বসতে চায় বলে গুঞ্জন রয়েছে।
বিএনএ/ রেহানা ইয়াছমিন