আমার এক বন্ধু এমপিএ ছিলেন ১৯৫৭ সালে মওলানা সাহেব যখন ন্যাপ করলেন ইস্কান্দার মির্জার সাহায্যে প্রগতিশীল বৈদেশিক নীতির ধুয়া তুলে, তখন ন্যাপ পার্লামেন্টারি পার্টি গঠন করে আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন উঠাইয়া নিলেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো । তখন তিনি ন্যাপের এক পার্টি মিটিংয়ে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা চলবে না । কে এস পি, নিজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ কোয়ালিশনকে সমর্থন করা উচিত । তখন কিছু কিছু সদস্য তার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, এই সমস্ত দল কি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন করতে পারে? এরা ইস্কান্দার মির্জার দালালি করছে । ইস্কান্দার মির্জা আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারকে ধ্বংস করতে চায় । আওয়ামী লীগ তো বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। যুক্ত নির্বাচনের জন্য যুদ্ধ করছে। কেমন করে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে এই সমস্ত নীতি বিবর্জিত দলদের সমর্থন করতে পারা যায়! মওলানা ভাসানী সাহেব তার উত্তর দিয়েছেন এই কথা বলে, মিশরের নাসের যদি সমাজতন্ত্র করতে পারে, তবে ইস্কান্দার মির্জাকেও একবার পরীক্ষা করে দেখলে অন্যায় কি? এরপরেই জানা গেল মওলানা সাহেব ইস্কান্দার মির্জার সাথে গোপন সন্ধিতে যোগ দিয়েছেন, ‘সোহরাওয়ার্দী নিধন’ যজ্ঞে । তাঁর নীতি আমার জানা আছে জেলে বসে আইয়ুব সাহেবের কাছে কি কি চিঠি দিয়েছেন তাও আমার জানা আছে ।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর দিন ফুরাইয়া এসেছে । একটু দেরি করুন দেখতে পাবেন, আপনার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা, আইয়ুব খান সাহেবের রূপ ।
বৃদ্ধকালে সরকারি ব্যয়ে একটু বিদেশে ঘুরবার সুযোগ পেয়েছেন দুনিয়া দেখতে কেহ আপত্তি করে না । জনগণের সাথে আর ছল চাতুরি না করাই শ্রেয় । আওয়ামী লীগ কর্মীরা ও জনগণ যখন জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও গণতন্ত্রের দাবির জন্য গুলি বুক পেতে নিতেছে, যখন কারাগার ভরে গিয়াছে তখন তাঁহার দলেরই দুই একজন নেতা এর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীর হাত দেখতে পেয়েছেন । এই অত্যাচারের প্রতিবাদও করেন নাই । জনগণ এদের চিনে ফেলেছে, সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নাই
আওয়ামী লীগের ডাকে জনগণ জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করছে খবর পেলাম, আর সরকারও অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাইয়া যেতেছে । দেখা যাক কি হয় ।
বিকালটা ভালই ছিল বৃষ্টি হয় নাই হাসপাতালে আহত কর্মীরা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আছে । নারায়ণগঞ্জের খাজা মহিউদ্দিন ও অন্যান্য কর্মীরা এবং সাহাবুদ্দিন চৌধুরী সাহেবও হাসপাতালে আছেন । তিনিও নেমে এসেছেন দরজার কাছে । আমি একটু এগিয়ে যেয়ে ওদের বললাম, ‘চিন্তা করিও না । কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না দেখ না আমাকে একলা রেখেছে।’ সিপাই সাহেবের মুখ শুকাইয়া গেছে, কারণ কথা বলা নিষেধ, চাকরি যাবে আমি এদের ক্ষতি করতে চাই না, তাই চলে এলাম আমার জায়গায় শুধু ওদের দূর থেকে আমার অন্তরের স্নেহ ও ভালবাসা জানালাম । জানি না আমার কথা ওরা শুনেছিল কিনা, কারণ দূর তো আর কম না!
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
কারাগারের রোজনামচা : পর্ব-৬১
কারাগারের রোজনামচা : পর্ব-৬০
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী