বিএনএ, বোয়ালখালী: ‘সূর্য উডের লে ভাই লাল মারি/রইস্যা বন্ধু গেলগুই ছাড়ি আঁরে বুকত ছেল মারি’। প্রতিদিনই ভোরের সূর্য এখনোও পূর্বাকাশে লাল মারি উঠলেও সেই অমর গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ নেই। লাখো কোটি ভক্তদের শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ সূর্যাস্তের সময় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এ শিল্পী। তবে গানের মাঝেই এখনো চিরঞ্জীব শেফালী ঘোষ।
১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগো পাড়ার ঘোষ পরিবারে শেফালী ঘোষের প্রথম কান্নার ধ্বনি ধ্বনিত হয়েছিল। সেই জন্মভিটার পুকুরপাড়ে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। আজ এই মহান শিল্পীর ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।
পিতা কৃষ্ণ গোপাল ও মাতা আশালতা ঘোষের ঘরে পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ভর্তি হন স্থানীয় মুক্তাকেশী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরিবারের অনুপ্রেরণায় তাঁর গান গাওয়ার ও শেখার সূত্রপাত ঘটে। শুরুতে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি এবং আধুনিক গান করলেও এক পর্যায়ে তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক গান, পল্লীগীতি, মাইজভান্ডারী গান গেয়ে অভাবনীয় শ্রোতাপ্রিয় হন।
তাঁর গানের প্রথম ওস্তাদ ছিলেন তেজেন সেন। পরবর্তী ওস্তাদ শিবশঙ্কর মিত্র, জগনান্দ বড়ুয়া, নীরোদ বরণ বড়ুয়া, মিহির নন্দী গোপালকৃষ্ণসহ অনেক সংগীতজ্ঞের কাছ থেকে তিনি তালিম নেন।
তাঁর গাওয়া ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে/ ছোড ছোড ঢেউ তুলি/লুসাই পাহাড়ত্তোন লামিয়েরে যারগোই কর্ণফুলী/ ওরে সাম্পান ওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা/ তুঁই যাইবা সোনা দিয়া বন্ধু মাছ মারিবাল্লাই/ ইত্যাদি মন ছুঁয়ে যাওয়া জনপ্রিয় গানগুলো তাঁকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
তখনকার সময়ে পাড়া মহল্লায় গানের আসর বসত। আয়োজন হত সাংস্কৃতিক অনুষ্টানের। সেখানে সবার আকর্ষণের মধ্যবিন্দু থাকতেন শেফালী ঘোষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর গবেষক ডি কে দাস মামুন বলেন, শেফালী ঘোষ বোয়ালখালীর ইতিহাসকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়েছে তার গানের মাধ্যমে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শিল্পী প্রায় পাঁচ দশকের সংগীত জীবনে প্রায় দুই হাজার গান গেয়েছেন। তাঁর গাওয়া গান নিয়ে দুই শতাধিকের বেশি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর মায়াবি কণ্ঠের গান সবাইকে আকর্ষণ করতো। ভরাট গলায় দরদি ও উদার কণ্ঠে গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আর কোন শিল্পী এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন কিনা তা বলা দুস্কর। তিনি আক্ষেপ করে বলেন শিল্পীর বাস্তুভিটায় একটি আবক্ষ ভাস্কর্য রয়েছে। সংস্কারের অভাবে তাও জরাজীর্ণ। সরকারি বা ব্যক্তি উদ্যেগে এগুলো সংরক্ষণ করে তাঁর স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখা প্রয়োজন।
১৯৭০ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করেন। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করেন।
সংগীতের পাশাপাশি সাম্পান ওয়ালা, মালকাবানু, মধুমিতা, বসুন্ধরা, মাটির মানুষ, স্বামী, মনের মানুষ, বর্গী এলো দেশে প্রভৃতি চলচ্চিত্রসহ প্রায় ২০টি চলচ্চিত্রে তিনি প্লেব্যাক করেছেন। এছাড়াও যাত্রা এবং মঞ্চনাটকেও তার নিয়মিত অংশগ্রহণ ছিল। দেশের গণ্ডী পেরিয়ে এশিয়া ইউরোপের প্রায় ২০টিরও অধিক দেশে তিনি গান গেয়ে চট্টগ্রাম তথা সারা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। পেয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক পদক, বাংলা একাডেমি আজীবন সম্মাননা পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক, একুশে পদকসহ অর্ধশতাধিক সম্মাননা।
মৃত্যুর ১৬ টি বছর পেরিয়ে গেছে। আজও তাঁর গান বাজে শ্রোতাদের হৃদয়ে। শেফালির কণ্ঠ মানুষের মনে এতই যে জায়গা করে নিয়েছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান মানেই শেফালী। সেই চিরচেনা কন্ঠ থেমে গেছে অনেক দিন। তবুও তিনি আছেন কর্ণফুলীর জলকলতানে, গানে গানে। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর গাওয়া হাজারো গান এখনো তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে কোটি মানুষের মনি কোটায়।
বিএনএ/বাবর, এমএফ