বিএনএ কক্সবাজার: জাস্ট গো নামের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ভ্রমণ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে ৩ জুলাই ২০২০ সালের ৩ জুলাই তিন সহযোগীসহ কক্সবাজার যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। শহরের কলাতলীতে ওয়াল্ড বিচ রিসোর্টে ওঠেন তারা।
৭ জুলাই ঠিকানা বদল করে হিমছড়ির নিলীমা রিসোর্টের ডি-১ কটেজে ওঠেন তারা। শুরু হয় কক্সবাজারের মনোরম দৃশ্য এবং বৈচিত্রপূর্ণ জীবন ও জীবিকার তথ্য সংগ্রহ আর ভিডিও চিত্র ধারণ।
এক পর্যায়ে টেকনাফে যান তারা। সেখানে গিয়ে মাদক নির্মূল অভিযানের নামে সাধারণ মানুষের ওপর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নিপীড়ন, ইয়াবা ব্যবসা ও ক্রসফায়ার বাণিজ্যের কথা জানতে পারেন সিনহা। ভূক্তভোগী অনেক পরিবার সিনহা ও তার টিমের কাছে ওসি প্রদীপের ইয়াবা ব্যবসা ও অত্যাচার, নিপীড়নের বর্ণনা দেন। এরপর ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও তাদের বাহিনীর নাম নানা তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন সিনহা এবং তার লোকজন। এরমধ্যে জুলাই মাসের কোন একদিন মেজর সিনহা, শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম রিফাতের সঙ্গে ওসি প্রদীপের দেখা হয়। নানা অভিযোগ সম্পর্কে ওসি প্রদীপের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন তারা। ঘটনাটি হালকাভাবে নেন মেজর সিনহা। টিম নিয়ে নিলীমা রিসোর্টে থেকে কাজ চালিয়ে যান তিনি। সংগ্রহ করেন ওসি প্রদীপ ও তার বাহিনীর ইয়াবা ও ক্রসফায়ার বাণিজ্যের তথ্য।
তবে, হুমকিতে কাজ না হওয়ায়, বিষয়টি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের আইসি ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীকে জানান ওসি প্রদীপ। থানার সোর্সদের সঙ্গে গোপনে কথা বলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিন সোর্স মো. নুরুল আমিন, আইয়াছ উদ্দিন এবং নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে করণীয় ঠিক করতে মিটিং করেন ওসি প্রদীপ ও ইন্সপেক্টর লিয়াকত।
এরপর তথ্য সংগ্রহে নামে তারা। ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তি ও অন্যান্য ভিক্টিম পরিবারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেজর সিনহা ও তার টিম সম্পর্কে খোঁজ নেয় সাদা পোশাকের পুলিশ ও সোর্স।
জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আইয়াছের সঙ্গে আবারও মিটিং করেন আইসি লিয়াকত আলী। সিনহা ও তার ভিডিও দলকে খুঁজে বের করতে তাড়া দেন। বলেন, তা না হলে লিয়াকতের বড় ধরণের ক্ষতি করবে ওসি প্রদীপ।
৩১ জুলাই রামু সেনা নিবাসের জিওসি’র বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী। ৩ নম্বর সার্ভিস পয়েন্টে উপস্থিত লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশ। অনুষ্ঠান শেষে সেই ভিডিও ধারণ করা দলটি সম্পর্কে লিয়াকতকে আবারও সতর্ক করেন ওসি প্রদীপ। এই বিষয়ে কোন ধরনের ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন প্রদীপ।
ওইদিনই বিকেল সাড়ে তিনটায় প্রাইভেটকার ঢাকা মেট্রো-গ ২৮-০৯৯৭ নিয়ে বের হন সিনহা। নিজেই ব্যক্তিগত গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন সাহেদুল ইসলাম সিফাত। গন্তব্য টেকনাফ থানার মারিশ বুনিয়া মুইন্ন্যা পাহাড়ের চূড়া। উদ্দেশ্য প্রতিদিনের মতো ভিডিও করা।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নতুন মেরিন ড্রাইভ রাস্তার পাশে গাড়িটি পার্কিং করে পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হন তারা। সিনহার পরনে ছিলো সেনাবাহিনীর পোষাকের মত কম্ব্যাট প্যান্ট ও কম্ব্যাট গেঞ্জি। পাহাড়ে ওঠার সময় মারিশ বুনিয়া মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমামের সঙ্গে সালাম বিনিময় হয় সিনহার। একটি ছোট ছেলের কাছ থেকে তারা পাহাড়ে ওঠার পথ জেনে নেন। পাহাড় ও সমুদ্রের মেল বন্ধনে সূর্যাস্তের টাইমল্যাপস ধারণ করতে করতে অন্ধকার হয়ে যায়।
রাত আটটার দিকে মেজর সিনহাকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলতে ফাঁদ পাতা হয়। দক্ষিণ মারিশবুনিয়া জামে মসজিদের ঘোষণা দেয়া হয় পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে। সে সময় জড়ো হয় কিছু লোক। কিন্তু পাহাড়ে কোনো সাড়াশব্দ বা লাইট না দেখা যাওয়ায় চলে যায় তারা। ফন্দিটি ভেস্তে গেলেও দমে যায়নি পুলিশের ৩ সোর্স।
এর কিছুক্ষণ পর পাহাড় থেকে পুলিশের ওই তিন সোর্সের সামনে দিয়ে নেমে আসেন মেজর সিনহা ও সিফাত। সে সময় তারা, সিনহা ও সিফাতের মুখের উপর টর্চ লাইটের আলো ফেলে নিশ্চিত হয় এই সেই ভিডিও দল। সিনহাকে অনুসরণ করে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত আসে নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ। তারা কোন দিকে যাচ্ছেন তা নিশ্চিত হন।
সোর্স নুরুল আমিনের ফোন পেয়ে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসেন ইন্সপেক্টর মো. লিয়াকত আলী। তড়িঘড়ি করে সঙ্গে কোন ফোর্স না নিয়ে এসআই দুলালসহ মোটরসাইকেলে সেখানে পৌঁছে অস্ত্রসহ অবস্থান নেন লিয়াকত। সিনহার গাড়ির আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
রাত ৯টা ২০ মিনিট। বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার গাড়ি। ৫ মিনিটেই গাড়িটি পৌঁছে শামলাপুর চেকপোস্টে। এপিবিএন সদস্য কনস্টেবল রাজীব গাড়িটি থামানোর সংকেত দেন। সংকেত পেয়ে থেমে যায় সিনহার গাড়ি।
কনস্টেবল রাজীব পরিচয় জানতে চাইলে বাম পাশে বসা সাহেদুল ইসলাম রিফাত গাড়ির জানালা খুলে দেন। সে সময় নিজের পরিচয় দেন গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা। কুশল বিনিময় শেষে কনস্টেবল রাজীব ও অন্য দুই এপিবিএন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী ও কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল-মামুন ইমন স্যালুট দিয়ে গাড়িটি চলে যাওয়ার সংকেত দেন।
সংকেত পেয়ে গাড়িটি এগোতেই মেজর সিনহা নাম শুনেই পেছন থেকে চিৎকার করে সামনে চলে আসেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত। আবার তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। পুণরায় নিজেকে মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা বলে পরিচয় দেন তিনি। নাম শুনে উত্তেজিত লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে ব্যারিকেট টেনে রাস্তা বন্ধ করে দেন লিয়াকত। রাস্তা ব্লকে লিয়াকতকে সহায়তা করেন এসআই নন্দ দুলালও।
লিয়াকত আলীর চোটপাটের মধ্যে দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন ২য় আসনে বসা সাহেদুল ইসলাম রিফাত। ড্রাইভিং সিটে বসা সিনহা গাড়ি থেকে দুই হাত উচু করে নেমে ইংরেজিতে কামডাউন কামডাউন বলে লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
৯টা ২৫ মিনিটে শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছে মেজর সিনহার গাড়ি। ঘটনার পর ৯টা ৩০ মিনিটে ১ মিনিট ১৯ সেকেন্ড এবং ৯টা ৪৫ মিনিটে ১৬ সেকেন্ড লিয়াকতের সঙ্গে ওসি প্রদীপের কথোপকথন হয়। ৯টা ৩৩ মিনিটে ঘটনাটি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে জানান আইসি লিয়াকত আলী।
এদিকে, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে কিছু পুলিশ সদস্য পাঠানোর জন্য বলেন এসআই নন্দ দুলাল। নির্দেশ পেয়ে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশায় চড়ে ছুটে আসেন এসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, কামাল হোসেন আজাদ ও ছাফানুল করিম। তাদেরকে সিনহার গাড়ি তল্লাশির নির্দেশ দেন লিয়াকত। তল্লাশি করে, গাড়ির ভেতরের সামনের দুই সিটের মাঝখান হতে একটি অস্ত্র পিস্তল, এবং ড্যাশ বোর্ডে কিছু কাগজপত্র, ক্যামেরা, সিডিবক্স, ও ভিডিও করার যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়।
লিয়াকত আলীর সফলতার ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ একটি সাদা মাইক্রোবাসে এবং তার সাথের ফোর্স একটি পিকআপ ভ্যানে চড়ে ঘটনাস্থলে আসেন। তখন রাত ১০টা। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর সঙ্গে একান্তে আড়ালে আলাপ করেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
তদন্ত কর্মকর্তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সিনহাকে লিয়াকত গুলি করেন আনুমানিক রাত ৯টা ২৫ থেকে ৯টা ৩০ এর মধ্যে।
হাসপাতালে নেওয়ার জন্য রাত দশটার কিছু আগে কনস্টেবল কামাল ও মামুন কোরবানির গরু বহনকারী একটি মিনি পিকআপ থামান। রাত ১০টা ৪৪ মিনিটের দিকে সিনহাকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গাড়িতে তোলা হয়। প্রায় ঘটনার সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর সিনহাকে বহনকারী পিকআপটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছে । রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে কতর্ব্যরত চিকিৎসক জানান ভিক্টিমকে মৃত আনা হয়েছে।
এরআগে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ রাত ১০টার সময় একটি মাইক্রোবাস ও একটি পিকআপ নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন।
ওসি প্রদীপ তার সঙ্গে আসা ফোর্সকে সিনহার গাড়িটি আবারও তল্লাশি করতে বলেন। টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব ও রুবেল শর্মা যে মাইক্রোবাস দিয়ে ওসি প্রদীপ এসেছিলেন তার দিকে যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তারা চিৎকার করে জানায় মেজর সিনহার গাড়ির ভেতর মাদক পাওয়া গেছে। যদিও আইসি লিয়াকত আলীর নির্দেশে ঘটনার পরপরই করা তল্লাশিতে কোন মাদক উদ্ধার হয়নি। এরপর সিনহার সঙ্গী সিফাতকে চেকপোস্টের ভেতর নিয়ে মুখের ওপর পানি ঢেলে এবং নানাভাবে নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
বিএনএনিউজ/আরকেসি