১২ই জুন ১৯৬৬ ॥ রবিবার
সকালে যখন হাঁটাহাঁটি করতেছিলাম তখন শুনলাম ৮২ জন ছেলে, যাদের ৭ই জুন গ্রেপ্তার করেছে তাদের দুইটি ব্লকে রাখা হয়েছে। সর্বমোট ৮টা ছোট ছোট সেল, চার হাত চওড়া আট হাত লম্বা। দুই নম্বর ব্লক খালি করে খুব ভোরে একজনকে এনে রাখা হয়েছে নাম আবদুল মান্নান । ভাবতে লাগলাম কোন মান্নান? জিজ্ঞাসা করলাম, চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কি না, কেউ বলতে পারল না । কোন ধারায় গ্রেপ্তার করেছে, বলল ডিপিআর না । খোঁজ নিয়ে জানলাম মামলা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ, তাতেই তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ডিভিশন দেয় নাই । এক কাপড়ে এসেছে । জুতা খুলে রেখেছে গেটে । গামছা নাই, কাপড় নাই, কোনো জামা নাই, যে জামাটি গায়ে দিয়ে এসেছে তা ছাড়া আমি তাড়াতাড়ি কিছু কাপড়চোপড় পাঠাইয়া দিলাম যাতে আপাতত চলতে পারে । ভাত নিতে যখন সেল থেকে বের হলো আমি দাঁড়িয়েছিলাম ওকে দেখতে । দেখলাম সত্যিই শ্রমিক নেতা মান্নান । তাকে বললাম, ‘চিন্তা করিও না, জামিনের চেষ্টা করতে হবে।’
কিছুই তো আমার ভাল লাগছে না। মায়ের খবর না পাওয়া পর্যন্ত মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। বাগানের কাজে হাত দিলাম। আবার ঘরে ফিরে এলাম । গতকালের কাগজগুলি আবার ভাল করে দেখতে লাগলাম । অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব ১৯৬৬-৬৭ সালের বাজেট পেশ করেছেন। রাজস্ব খাতে আয় ধরা হইয়াছে ৫৬৩ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। ব্যয় হইবে ৩৭২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। ১২৭ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা প্রদেশের ভাগে যাবে। রাজস্ব খাতে ৬৩ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। উন্নয়ন খাতে আর্থিক বৎসরে ৪৪২ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা আয় হইয়াছে, ব্যয় বরাদ্দ হইয়াছে ৪৭৯ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা । উন্নয়ন খাতে ৩৬ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা ঘাটতি পড়িবে । নূতন কর বসাইয়াছে তাহাতে ৩৭ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা আদায় হইবে। কেরোসিন, লবণ, সাবান অন্যান্য জিনিসের উপর কর ধার্য হয়েছে। ডাক মাশুলও বাড়াইয়াছে । দেশরক্ষা খাতে ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধরা হইয়াছে । ১৯৬৫-৬৬ সালে ১৩৬ কোটি টাকা ছিল । যে কর ধার্য করা হইয়াছে তাহার সবটাই গরিবকে দিতে হইবে শোয়েব সাহেব যে অর্থনীতি চালু করিয়াছেন তাহাতে গরিবকে আরও গরিব করিয়া কয়েকজন বড় লোক ও শিল্পপতিকে সুযোগ-সুবিধা করিয়া দিবার ষড়যন্ত্রই কায়েম হইবে ।
সরকার ক্রমাগত কর ধার্য করিয়া জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা বাড়াইয়া চলিয়াছেন । শোয়েব সাহেব অর্থনীতিতে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন । তাঁর বাজেটে এই শিল্পপতিদের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে’ ভোগের ব্যবস্থা রাখিয়াছেন। কিন্তু গরিব জনসাধারণ বোধ হয় আর আলো জ্বালাইয়া রাতের খাবার খেতে পারবে না। খাবার জন্য কিছুই থাকবেও না। দেশ রক্ষা খাতে যে শতকরা ৬৫ ভাগ ব্যয় করা হবে এর মধ্যে পূর্ব বাংলা কতটুকু পাবে? ৫/১০ ভাগ এর বেশি নিশ্চয়ই না ।
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৮৩-৮৪ লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী