বিশ্ব ডেস্ক : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাহী আদেশে বৈদেশিক সহায়তা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এর প্রভাব অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত বেশ কিছু প্রকল্প স্থগিত বা বন্ধ করা হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মীদের হোম অফিসের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নে কী প্রভাব পড়বে?
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্যের সবচেয়ে বড় দাতা দেশগুলোর একটি। ২০২৩ সালে দেশটি আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। বাংলাদেশে ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি সহায়তা দেয়া হয়েছে। ২০২৪ সালে এই সহায়তার পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৯০ মিলিয়ন ডলার।
ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএইড) এর মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা, পরিবেশ ও জ্বালানি, মানবিক সহায়তা এবং রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থায়ন করা হতো। তবে, নতুন আদেশের ফলে এই খাতে অর্থায়ন স্থগিত হওয়ায় বাংলাদেশে উন্নয়ন কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
কোন খাতে কতটা প্রভাব পড়বে?
১. খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি:
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি উন্নয়নে ইউএসএইডের বড় ধরনের অবদান রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের ২৩টি জেলায় এ সংক্রান্ত প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছিল, যা বর্তমানে স্থগিত হয়েছে।
২. গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শাসনব্যবস্থা:
বাংলাদেশে সুশাসন ও মানবাধিকার রক্ষায় ইউএসএইডের বিভিন্ন প্রকল্প চালু ছিল। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের প্রতি নাগরিকদের আস্থা বৃদ্ধির এসব কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
৩. পরিবেশ ও জ্বালানি:
প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও জ্বালানি নিরাপত্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম স্থগিত হলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশকে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।
৪. স্বাস্থ্যসেবা:
মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে মার্কিন সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। অর্থায়ন বন্ধ হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হতে পারে।
৫. শিক্ষা:
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে পরিচালিত কর্মসূচিগুলো থমকে গেলে শিক্ষার্থীদের উন্নত শিক্ষার সুযোগ কমে যেতে পারে।
৬. রোহিঙ্গা সহায়তা:
রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হলেও অন্যান্য প্রকল্প স্থগিত হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
ব্র্যাকসহ উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কার্যক্রম স্থগিত
বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত ছয়টি প্রকল্প স্থগিত করেছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ জানান, এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে তিনটি সরাসরি ব্র্যাক পরিচালিত এবং বাকি তিনটি অন্যান্য এনজিওর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছিল।
এছাড়া, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান ও লাইবেরিয়ায় ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চলমান তিনটি প্রকল্পও আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ব্র্যাকের হিসাবে, এই প্রকল্পগুলোর স্থগিত হওয়ায় অন্তত ৩৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মীদের অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, তিন মাসের স্থগিতাদেশের কারণে তাত্ক্ষণিকভাবে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি আরও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, “কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা জলবায়ু বিষয়ক প্রকল্পগুলো যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শুধু উন্নয়ন কার্যক্রমই নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতেও চাপ তৈরি করবে।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, “জলবায়ু পরিবর্তন, জেন্ডার বা সুশাসন সংক্রান্ত ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান ইতিবাচক নয়। ফলে তিন মাসের পর্যালোচনার পরও এসব খাতে সহায়তা পুনর্বহাল হবে কিনা তা অনিশ্চিত।”
মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাংলাদেশে চলমান সকল প্রকল্প ও কর্মসূচির ব্যয় অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। ইউএসএআইডির বাংলাদেশ কার্যালয়ের পরিচালক রিচার্ড বিষয় অ্যারন গত শনিবার স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্যে এ নির্দেশনা জারি করেন।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ইউএসএআইডির চুক্তিভুক্ত প্রকল্প ও কর্মসূচির মার্কিন অংশের ব্যয় বন্ধ রাখতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জারি করা নির্বাহী আদেশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গত ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর হোয়াইট হাউস থেকে বৈদেশিক সহায়তা পুনর্মূল্যায়ন ও পুনঃসামঞ্জস্যকরণের ঘোষণা দেয়।
ইউএসএআইডির অধিগ্রহণ ও সহায়তা বিষয়ক কার্যালয়ের পরিচালক ব্রায়ান অ্যারনের পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ইউএসএআইডি-বাংলাদেশের সাথে চুক্তিবদ্ধ সব সংস্থার প্রকল্প ও কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ, স্থগিত বা থামানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চলমান কার্যক্রমে ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য যুক্তিসংগত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রকল্প বন্ধের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মার্কিন দূতাবাস ও পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, গত পাঁচ দশকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ বিভিন্ন খাতে ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ি, যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালে ৪৯০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে।
বিশেষ করে, রোহিঙ্গা সংকটের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে। বিগত কয়েক বছরে মার্কিন সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ছিল।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয়
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ মনে করেন, “এখনই সব কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন নয়। তবে, প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বোঝানোর জন্য আগামী তিন মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি বলেন, “প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন থমকে গেলে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে, যা অবশেষে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটি সমস্যার কারণ হতে পারে।”
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর উচিত মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং বিকল্প উৎস থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। অন্যথায়, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সূত্র :বিবিসি
বিএনএনিউজ24,এসজিএন