23 C
আবহাওয়া
১১:৫৫ অপরাহ্ণ - ডিসেম্বর ৩, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » চট্টগ্রামে ৬৪ বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে ২০০ কিশোর গ্যাং

চট্টগ্রামে ৬৪ বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে ২০০ কিশোর গ্যাং

চট্টগ্রামে ৬৪ বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে ২০০ কিশোর গ্যাং

।। শামীমা চৌধুরী শাম্মী ।।

বিএনএ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মহানগরের বাসিন্দারা কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে। ১৬ থানায় এখন সক্রিয় রয়েছে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং। এদের সদস্যসংখ্যা ২ হাজারের বেশি। এসব কিশোর গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাই’। উঠতি তরুণদের দলে ভেড়াতে ‘বড় ভাইয়েরা’ প্রশ্রয় দেন।

মূলত এলাকায় চাঁদা আদায়, আধিপত্য বজায় এবং মাদক ব্যবসা করতে তারা কিশোর গ্যাং গড়ে তোলেন। এলাকায় প্রভাব বাড়ানোর জন্য কিশোরদের হাতে অস্ত্র, মাদক তুলে দিচ্ছেন কথিত বড় ভাইয়েরা। শহরের আগ্রাবাদ, পাচলাইশ, নাসিরাবাদ, খুলশী আবাসিক এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে কথিত কিশোর গ্যাং। প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। মামলাও করতে চান না।

YouTube player

এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে খুনোখুনি থেকে শুরু করে জায়গা দখল, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারামারি, অস্ত্রবাজি, উত্ত্যক্তসহ নানা অপরাধে জড়িয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এদের বেশিরভাগই বেড়ে উঠেছে বস্তি ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। নামে কিশোর গ্যাং হলেও দলে ২০ থেকে ৩২ বছর বয়সীরাও রয়েছেন।

২০১৮ সালে নগরের জামাল খান এলাকায় স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে গুলি করে খুনের ঘটনার পর নগরে কিশোর গ্যাং আলোচনায় আসে। এর পরের বছর নগর পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করে। এর পর থেকে গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।

২০১৯ সালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের করা তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের প্রশ্রয়দাতা ছিলেন ৪৮ জন, যারা এলাকায় ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ নতুন করে তালিকা না করলেও বিভিন্ন ঘটনা ও মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নতুন কমপক্ষে ১৬ জন ‘বড় ভাইয়ের’ খোঁজ পেয়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ১৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব ও পুলিশ।

কিশোর অপরাধের মামলাও বেড়েছে চট্টগ্রাম আদালতে। বর্তমানে ২ হাজার ২৩২টি মামলা বিচারাধীন। অথচ তিন বছর আগে ২০২১ সালে কিশোর অপরাধের মামলা ছিল ১ হাজার ৮৮টি।

নুর মোস্তফা ওরফে টিনু কোনো পদে না থাকলেও নিজেকে পরিচয় দেন নগর যুবলীগের নেতা হিসেবে। তিন বছর আগে অস্ত্র–গুলিসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকাকালে সিটি করপোরেশনের ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তার একার প্রশ্রয়ে রয়েছে ১৪টি কিশোর গ্যাং।

মেহেদী হাসান নামের এক যুবককে ওয়ার্ড কার্যালয়ে নিয়ে হুমকি ও মারধরের অভিযোগে নুর মোস্তফা ও তার কিশোর গ্যাং গ্রুপের পাঁচজনের বিরুদ্ধে গত ৩ মার্চ পাঁচলাইশ থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় আত্মসমর্পণ করলে ১৯ মার্চ জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত। এটি ছাড়া তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ চারটি মামলা রয়েছে। নুর মোস্তফার প্রশ্রয়ে থাকা ১৪টি কিশোর গ্যাং ছাড়া চকবাজার এলাকায় আরও ৮টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও নগর যুবলীগের সহসভাপতি ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী। জিইসি, পাহাড়তলী, খুলশী এলাকায় ওয়াসিমের প্রশ্রয়ে থাকা চারটি কিশোর গ্যাং রয়েছে- ব্ল্যাক শামীম, সোলেমান বাদশা, সাহেদ ও কাইয়ুম গ্রুপ। তবে ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী তার সঙ্গে কোন কিশোর গ্যাংয়ের সর্ম্পক নেই বলে জানিয়েছেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে নগরের একটি ভোটকেন্দ্রের বাহিরে অস্ত্র উঁচিয়ে তার এক অনুসারী মো. শামীমের করা গুলিতে দুজন আহত হন। এই ঘটনার মামলায় ওয়াসিমকেও আসামি করা হয়েছে। পরে র্যাব শামীমকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে।

নুর মোস্তাফা, ওয়াসিম উদ্দিন ছাড়াও পুলিশের তালিকায় ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এসরারুর হকের বিরুদ্ধে রয়েছে কিশোর গ্যাং লালনের অভিযোগ। চার মামলার আসামি এসরারুর হকের প্রশ্রয়ে রয়েছে চারটি কিশোর গ্যাং। এগুলো হচ্ছে ধামা জুয়েল, লম্বা দিদার, সোহেল ও রিফাত গ্রুপ।

১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি আবুল হাসনাত ওরফে বেলাল, পুলিশের খাতায় তার নাম রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হিসাবে। আবুল হাসনাত প্রশ্রয় দেন চারটি গ্রুপকে। এগুলো হচ্ছে ডিশ সালাউদ্দিন, জাহিদ, নাহিদ ও তানজিদ গ্রুপ।

৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিমের বিরুদ্ধেও রয়েছে কিশোর অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ। জহুরুলের বিরুদ্ধেও রয়েছে পাহাড় কাটা ও হামলার চারটি মামলা। জহুরুল হকের প্রশ্রয়ে আছে চারটি কিশোর গ্রুপ। এগুলো হচ্ছে বিল্লাল, সালাউদ্দিন, শাকিল ও আনিস গ্রুপ।

চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার ও ডাকাতি মামলার আসামি মো. ফিরোজ। নিজেকে তিনি যুবলীগ নেতা হিসেবে দাবি করে থাকেন। ‘রিচ কিডস’ গ্যাং পরিচালনা করেন হত্যা ও ডাকাতি মামলার আসামি ফিরোজ। অর্ধশতাধিক কিশোর ও তরুণ সক্রিয় এই গ্রুপে। নগরের মুরাদপুর, নাসিরাবাদ, ষোলশহর ও পাঁচলাইশ এলাকায় সক্রিয় এই গ্রুপ।

এছাড়া নগরের দুই নাম্বার গেট, জিইসি, জাকির হোসেন রোড, আল ফালাহ গলি ও নাসিরাবাদ এলাকায় সক্রিয় শুলকবহর ওয়ার্ডের কথিত যুবলীগ নেতা সোলাইমান বাদশার গ্যাং। এই গ্যাংয়ের ‘ডিএক্স বয়েজ’ নামে একটি ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ রয়েছে। এ গ্রুপের সদস্যরা ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশের এক এসআইকে গুলি করে। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসিম আহমদ সোহেল হত্যার অভিযোগও রয়েছে এ গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে।

কোতোয়ালি ও বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেশি বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন। এর মধ্যে কোতোয়ালিতে ২৩টি ও বায়েজিদে আছে ১৯টি গ্রুপ।

কোতোয়ালি থানা এলাকার মধ্যে আলোচিত গ্রুপগুলোর অন্যতম চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রউফের প্রশ্রয়ে থাকা রউফ গ্রুপ, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হকের এনাম গ্রুপ, যুবলীগ নামধারী এখলাস উদ্দিনের আরমান গ্রুপ, যুবলীগ নামধারী আবদুল্লাহ আল সাইদের সাইদ গ্রুপ, যুবলীগ নামধারী মহিউদ্দিনের প্রশ্রয়ে থাকা তুষার গ্রুপ।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা, পলিটেকনিক ও শেরশাহ এলাকায় রয়েছে নগর যুবলীগ সদস্য আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের প্রশ্রয়ে থাকা মহিউদ্দিন গ্রুপ। ওই এলাকায় রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিত দিদারুল আলম, মো. শফি ও আবদুল কুদ্দুসের প্রশ্রয়ে থাকা আলাদা আলাদা গ্রুপ। আবার বায়েজিদ হিলভিউ এলাকায় জাহিদ হোসেনের জাহিদ গ্রুপ ও সাইফুল আলমের প্রশ্রয়ে রয়েছে সাইফুল গ্রুপ।

এর বাহিরে যুবলীগ নেতা নামধারী রিটু দাশ এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক সাইফুল আলম ওরফে লিমন, লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম ওরফে মাসুমের প্রশ্রয়ে সিআরবি, কদমতলী, খুলশী, আমবাগান ও টাইগারপাস এলাকায় অন্তত ১০টি গ্রুপ সক্রিয়। তাঁরাও সবাই কিশোর গ্যাং প্রশ্রয়ের কথা অস্বীকার করেন। এছাড়া আরও ৪৩ ‘বড় ভাই’ রয়েছেন, যাঁরা কিশোর গ্যাং প্রশ্রয় দিচ্ছেন। চকবাজার, কোতোয়ালি ও বায়েজিদের বাহিরে বাকি ১৩ থানায় রয়েছে ১৭৮টি গ্রুপ।

এখনই কিশোর গ্যাং ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের লাগাম টানতে না পারলে নগরবাসী ও আইন শৃঙ্খলার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠবে, এমনটাই মনে করেন সচেতন মহল।

বিএনএনিউজ/ বিএম/এইচমুন্নী 

Loading


শিরোনাম বিএনএ