।। মিজানুর রহমান মজুমদার।।
‘আল্ হাক্কু মুররুন’। এটি আরবি প্রবাদ। অর্থাৎ ‘সত্য কথা শুনতে কর্কশ’। করোনাকালীন ঈদে কিছু কর্কশ কথা বলতেই হচ্ছে। ‘ঈদ’ আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো ফিরে আসা। ঈদ যেহেতু আনন্দের বার্তা নিয়ে মুসলমানের দ্বারে দ্বারে বার বার ফিরে আসে, সঙ্গত কারণেই এ আনন্দকে ‘ঈদ’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। অন্যভাবে বললে রোজা ভাঙ্গার দিন। এদিন ভালো খাওয়া-দাওয়া করা এবং নতুন বা পরিস্কার কাপড় পরিধান করা সুন্নত। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা এই দিন খুবই আনন্দের সঙ্গে পালন করেন।
মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে এদেশের ধনী-দরিদ্র মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঈদোৎসব পালন হয়ে আসছে। প্রতিবছর সারা বিশ্বের মুসলমানদের অন্যতম আনন্দ উৎসব হিসাবে পালন করে আসছে। কালক্রমে এটি সামাজিক ও পারিবারিক উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু এবার সেই পরিস্থিতি নেই। পুরো বিশ্বের মানব জাতিকে গ্রাস করতে ছোবল হেনেছে অদেখা শত্রু কথিত করোনা ভাইরাস( কোভিড-১৯)। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে এ ভাইরাসের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে গাণিতিক হারে। এ প্রাণঘাতি ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় সামাজিক ও শারিরীক দুরত্ব বজায় রাখা।
সরকার বন্ধ ও লকডাউন ঘোষণা দিয়েছে। যে যেখানে আছে, সেখানে ঘরে থাকতে বলেছেন। জারি করেছেন বিভিন্ন নির্দেশনা। সচেতনতা সৃষ্টি করতে নিয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচী। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ কোন নির্দেশনা মানছেন না। সচেতনা বলতে কী তা বুঝেনই না। মাস্ক ছাড়া গাদাগাদি করে তিন/চারগুন ভাড়া দিয়ে কেন যেতে হবে বাড়িতে? সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন করোনাভাইরাস! ভাবখানা এমন ঈদ আর আসবে না!
ধর্মীয় একটি সুন্নত, সামাজিক একটি রীতি পালন করার জন্য লকডাউন ও করোনা সংক্রমনকে উপেক্ষা করে মানুষ যেভাবে শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে, বাজারে যাচেছ, মসজিদে যাচ্ছে তা জাতির জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনছে।
সম্প্রতি সরকার শপিং মল খুলে দিয়েছে। রাজধানীতে এক তরুণী শপিং মলে গিয়ে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘করোনা একটা ছোট ভাইরাস তার জন্য তো ঈদ থেমে থাকতে পারে না!’ এটিই বাংলাদেশের বাস্তব সমাজ চিত্র।
কথিত মানুষ নামের ওই তরুণী ঠিকই বলেছে ‘করোনা’ ছোট ভাইরাস। কিন্তু এই ছোট ভাইরাসটি কোন জাত, ধর্ম, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র চিনে না। সে চিনে শুধু মানবদেহ। ওই তরুনীর জানা নেই এই ভাইরাসের ভয়াবহতা। না জানা, অপরাধ নয়। কিন্তু যখনই সরকারের নির্দেশনা অমান্য, অবহেলা, অবজ্ঞা করা হয় সেটি অপরাধ। রাষ্ট্রের উচিত তাদের শাস্তির আওতায় আনা।
একটু নজর দিলে দেখা যায়, করোনা ভাইরাসে শিকার মা-বাবার আহজারি, সন্তানের আত্মচিৎকার, স্বামী ছটফট করছে। কেউ কাছে যাচ্ছে না। শেষ বিদায়ে আদরে হাতের পরশ পাচ্ছেন না স্বজন। মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা ব্যাংকে আছে। কিন্তু সে টাকা কোন কাছে লাগছে না। যারা সর্দি-কাশি হলেই সিঙ্গাপুুর ব্যাংকক যেতেন এয়ারবাস কিংবা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে। সেই আকাশপথ এখন বন্ধ।যেতে পারছেন না তারা। এ অবস্থায় সরকারি তৃতীয় শ্রেণির হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। সেখানে থাকা হাতেগোনা আইসিও ভেন্টিলেশন পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।
একটি শিল্প গ্রুপের পুরো পরিবারে করোনা হানা দিয়েছে। ওই শিল্প গ্রুপের প্রধান কর্ণধার বিদেশে থাকায় মুক্ত থাকলেও তার মা,ভাই, সন্তান করোনায় আক্রান্ত। অসুস্থ এক ভাইয়ের ভেন্টিলেশন খুলে আরেক ভাইকে দেয়া হয়েছে। তারপরও বাঁচানো যায় নি। চলে যাচ্ছেন, গেছেন পরপারে। আকাশ পথ বন্ধ থাকায় শরিক হতে পারেনি ভাইয়ের শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠান- জানাজায়। বলা হচ্ছে, ৫ লাখ টাকা দামের একটি ভেন্টিলেশনের অভাবে একজন শিল্পপতির মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ বাজার পেয়েছে। অনেকে নসিহত করেছেন ওই শিল্প গ্রুপকে তারা যেন একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তুলেন। নসিহতকারিরা জানেননা দিনে দিনে বিশেষায়িত হাসপাতাল হয় না, সম্ভব না।
যেসব হাসপাতাল বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠেছে সেগুলোকে আমরা একটি সুষ্টু ব্যবস্থাপনায় আনতে পেরেছি? চট্টগ্রামে শত কোটি টাকার বিনিময়ে ইম্পেরিয়াল নামে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশ্বের বিখ্যাত হার্ট স্পেশালিষ্ট ডা. দেবী শেঠী এটির প্রধান উদ্যেক্তা। কিন্তু বিদেশী ডাক্তার এখানে চিকিৎসা দিতে পারবেন না। এমন অভিযোগ তুলে কতিপয় বিএমএ নেতারা তা সচল করতে দেয়নি! করোনাকালীন সময়ে আমরা কী পেরেছি শত কোটি টাকার এ বিশেষ হাসপাতালকে সচল করতে। গোষ্টী স্বার্থের কাছে, চাপের কাছে জিম্মি হয়ে আছে পুরো সমাজ ব্যবস্থা। এ অবস্থায় বেদনার বিষাদের এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি পুরো জাতি।
কবিরা দার্শনিকও বটে। অনেক কিছু আগে দেখে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী জানতেন ৭০ বছর পর কঠিন সত্যের মুখোমুখি হবে বিশ্ব? ১৯৫১ সালে ১০ মে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘রূপ নাবানের কূলে’ কবিতায় লিখেছেন-
‘সত্য যে কঠিন/ কঠিনেরে ভালবাসিলাম/ সে কখনো করে না বঞ্চনা..।’ রবি ঠাকুরের এমন কবিতার চারণে দুটো বিষয় লক্ষ্য করা যায় প্রথমত: ‘সত্য কঠিন।’ দ্বিতীয়ত: ‘কঠিন কাউকে বঞ্চনা করে না।’ সত্য যেহেতু কঠিন, তাই সত্যও কাউকে ঠকায় না। অনেক সময় আমরা সত্যকে সত্য হিসেবে বোঝতে চাই না, বুঝি না, গ্রহণ করতে চাই না।
করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক একটি মহামারি। এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা যত বেশি সচেতন হয়ে ঘরে থাকা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে পারবো তত দ্রুত এ মহামারি থেকে রক্ষা পাব। দেশ হবে বিষাদ ও বিপর্যয়মুক্ত।