বিএনএ ডেস্ক :১০ বছর আগে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের স্থান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কাতারে ছয় হাজার ৫০০ জনের বেশি অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এরা সবাই ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া শ্রমিক। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছে।
সংগৃহীত সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ডিসেম্বরের যেই রাতে দোহা ভেন্যু নির্বাচিত হওয়ার উৎসব উদাযপন করছিল, সেই রাত থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতি সপ্তাহে এশিয়ার পাঁচ দেশের ১২ শ্রমিক মারা গেছে। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পাঁচ হাজার ৯২৭ জন শ্রমিক মারা গেছে। এর মধ্যে ভারতের দুই হাজার ৭১১ জন, নেপালের এক হাজার ৬৪১ জন, বাংলাদেশের এক হাজার ১৮ জন, পাকিস্তানের ৮২৪ জন এবং শ্রীলঙ্কার ৫৫৭ জন শ্রমিক।
মৃত্যুর এই সংখ্য অবশ্য সর্বমোট নয়। কারণ এর মধ্যে ফিলিপাইন ও কেনিয়াসহ অন্যান্য দেশের মারা যাওয়া শ্রমিকদের অর্ন্তভূক্ত করা হয়নি। এমনকি ২০২০ সালের শেষ মাসগুলোতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদেরও এই তালিকায় যোগ করা হয়নি।
২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনকে সামনে রেখে গত ১০ বছর ধরে কাতার বিপুল সংখ্যক ভবন নির্মাণ করেছে। এসব প্রকল্পের বাইরে নতুন সাতটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া একটি নতুন বিমানবন্দর, গণপরিবহন ব্যবস্থা, হোটেল এবং নতুন একটি শহর নির্মাণের কাজ হয় শেষের পথে নতুবা শেষ হয়ে গেছে।
উপসাগারীয় অঞ্চলে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ফেয়ার স্কয়ার প্রজেক্টসের পরিচালক নিক ম্যাকগিহান জানান, পেশা কিংবা কর্মস্থল হিসেবে মারা যাওয়া শ্রমিকদের শ্রেণি বিন্যাস করা হয়নি। তবে এই তালিকার অধিকাংশকে বিশ্বকাপ আয়োজনের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘২০১১ সাল থেকে যেসব প্রবাসী শ্রমিক মারা গেছেন, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পাওয়ার পর সেখানে গিয়েছিলেন।’
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, মারা যাওয়া ৩৭ শ্রমিক বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম নির্মাণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। অবশ্য বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি এর মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যুকেই ‘কাজের বাইরের ঘটনায়’ মৃত্যু বলে চালিয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা কমিটির ব্যবহৃত এই ‘কাজের বাইরের ঘটনায়’র দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ স্টেডিয়াম নির্মাণ এলাকায় দেয়াল ধসেসহ কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া শ্রমিকদের বেলায়ও কাতারি কর্তৃপক্ষ এই দাবি করেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাতার ২০ লাখ অভিবাসী শ্রমিককে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি মৃত্যুর এই উচ্চহার তদন্তেও ব্যর্থ হয়েছে।
নির্মম মৃত্যুর এই তালিকায় মারা যাওয়ার যেসব কারণ প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, উচ্চতা থেকে পতন, একাধিক ভোঁতা আঘাত, ঝুলে থাকার কারণে শ্বাসকষ্ট। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৃতদেহে পচনের কারণে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটি উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু।’ এই দাবির পক্ষে বলা হয়েছে হৃদযন্ত্রের তীব্র সমস্যা কিংবা তীব্র শ্বাসকষ্টের সমস্যা।
গার্ডিয়ানের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মারা যাওয়া শ্রমিকদের ৬৯ শতাংশকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলা হয়েছে। পৃথকভাবে ভারতের শ্রমিকদের বেলায় এই হার ৮০ শতাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাশের ময়নাতদন্ত করতে দেওয়া হয় না। এর ফলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অজানাই থেকে যায়।
২০১৯ সালে কাতারের তীব্র তাপমাত্রা শ্রমিকদের মৃত্যুর বড় একটি কারণ ছিল। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার গবেষণায় পাওয়া গেছে, বছরের অন্তত চার মাস তীব্র দাবদাহের মধ্যে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের।
২০১৪ সালে কাতার সরকারের নিজস্ব আইনজীবীরা প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ায় ময়নাতদন্তের পরামর্শ দিয়েছিল। এর জন্য তারা আইন সংশোধনেরও পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু সরকার এর কোনোটিই কানে তোলেনি।
কাতার সরকার অবশ্য দাবি করছে, দেশটিতে শ্রমিকের মৃত্যুর হার স্বাভাবিক। কাতারে প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সেই হারেই মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। এই তালিকায় কর্মকর্তা পর্যায়ের ব্যক্তিরাও রয়েছেন যারা দীর্ঘদিন কাতারে বাস করেছে।
এক বিবৃতিতে কাতার সরকার বলেছে, ‘জনসংখ্যা অনুপাতে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রত্যাশিত সীমার মধ্যে রয়েছে। যাই হোক, প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখজনক এবং মৃত্যু আটকানোর জন্য চেষ্টার কমতি নেই।’