অনেক রিকশাওয়ালাকে এনেছে, বোধ হয় বাড়িতে তাদের ছেলেমেয়ে না খেয়েই আছে । দুই মাসের সাজা দিয়েছে অনেককে। দুপুর হয়ে গেল এই ভাবেই । কাগজ এল, দেখলাম তথাকথিত জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বিরোধী দল ওয়াক আউট করেছে প্রতিবাদে । কারণ মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার সাহেব উঠাতে দেন নাই। একেই বলে আইন সভা আর একেই বলে আইন সভার ক্ষমতা! চমৎকার ফার্স। ডিবেটিং ক্লাব বললেও চলে । তাহাও সব ক্ষেত্রে বলা চলে না। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, ‘যেই না মাথার চুল তার আবার লাল ফিতা।’
সরকার স্বীকার করেছে আরও একজন হাসপাতালে মারা গিয়াছে এই নিয়ে ১১ জনের মৃত্যু হলো । যারা আহত হয়েছে তাদের কোনো সংবাদ নাই আজ পর্যন্ত । প্রশ্ন জাগে, ‘১১ জন মারা গেছে না অনেক বেশি মারা গেছে?’
সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন একটি চমৎকার কথা বলেছেন। কথাটি একেবারে সত্য। ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সম্পর্কে বলেছেন, “জয়ের সাধ্য নাই, ফেরারও পথ পাইতেছে না।
পাঁচটার সময় বাইরে যেয়ে একাকী বসে চিন্তা করছি এমন সময় জমাদার সাহেব এসে বললেন, চলুন আপনার ইন্টারভিউ আছে, বেগম সাহেবা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। হঠাৎ এল, ব্যাপার কি! আজকাল তো ১৫ দিনের কমে দেখা করতে দেয় না। আগে যখন জেলে এসেছি তখন দেখা করতে অনুমতি দিত । কোনো খারাপ খবর কিনা? তাড়াতাড়ি রওয়ানা হলাম জেল গেটের দিকে । প্রায় দুই তিন শত ছেলে কয়েদির কাপড় পরে, ফাইল করে বসে আছে। আমাকে দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেল। আমাকে হাত তুলে এক সাথে অভিবাদন জানাল, আমিও তাদের অভিনন্দন দিলাম। দাঁড়াবার হুকুম নাই, জেলের আইনে । তাই গেটের দিকে চললাম । শুভেচ্ছা জানিয়ে চললাম ছোট্ট ছেলেটা পূর্বের মতোই ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে উঠল । আমি তাকে কোলে নিলাম । আদর করলাম । বাচ্চা মেয়েটি দরজার কাছে দাঁড়াইয়া ছিল । তাকেও আদর করলাম। জামালের জ্বর, দূরেই বসেছিল, কাছে ডেকে আনলাম। বড়মেয়ে, বড় ছেলে, খোকা, আমার স্ত্রী একে অন্যের দিকে চাইছে, কি যেন বলতে চায় বলতে পারছে না। আমি বললাম এত তাড়াতাড়ি দেখা করার অনুমতি দিল ব্যাপার কি?
আমার স্ত্রী আস্তে আস্তে বলল যে, “টেলিগ্রাম এসেছে মার শরীর খুব খারাপ বুঝতে আর বাকি রইল না, মার শরীর বেশি খারাপ না হলে আমার আব্বা কোনোদিন টেলিগ্রাম করতেন না ।” তিনি খুব বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোক মনটা আমার খুবই খারাপ হয়ে পড়ল । ছেলে-মেয়েদের বুঝতে দিলাম না যে আমি খুব মুষড়ে পড়েছি । কিছু সময় বসলাম, কোনো কথাই আমার আর ভাল লাগল না। বেগম সাহেবার কাছ থেকে একটা পান খেলাম। ঢাকার ও অন্যান্য স্থানের অবস্থা যে খুব খারাপ বুঝতে বাকি রইল না। আমার স্ত্রী বললো প্যারোলের জন্য দরখাস্ত করতে। আমি বললাম “কয়েকদিনের জন্য যেয়ে মার শরীর যদি ভাল না হয় তাঁকে ফেলে আবার জেলে ফিরে আসলে তাঁর হার্টফেল করে যেতে পারে। মুক্তি দেয় যাব, নতুবা নয়। কাউকে সত্ত্বর পাঠাইয়া দেও, নাসেরকে খবর দেও বাড়ি যেতে।
সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
পড়ুন আগের পর্ব :
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী,এসজিএন