বিএনএ, ঢাকা: এতক্ষণ যার কথা ও অট্টহাসি শুনলেন তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে যান, তখন সাইফুজ্জামানও দেশ ছেড়ে চলে যান।
সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সন্তান। বাবার মৃত্যুর পর তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। বাবার শূন্য আসনে উপ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথমবার এমপি হন দশম জাতীয় সংসদে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী হন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত সাইফুজ্জামান চৌধুরী ভূমি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ভূমি মন্ত্রী হওয়ার পর তাকে পেয়ে বসে ভূমির নেশায়।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী হলেও তার দেশের ভূমি অপছন্দ। তার পছন্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাইসহ উন্নত দেশের ভূমি।
ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও বিলাসী জীবন নিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘আলজাজিরা’ গত ১৮ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ একটি অনুসন্ধানি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, যুক্তরাজ্য ছাড়াও তিনি নিজের রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছেন দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। যদিও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ শাখা শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিদেশে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সম্পদ থাকার বিষয়টি প্রথম প্রকাশ করেছে। যা নিয়ে দেশ বিদেশের গণমাধ্যমে তা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। ওই সময় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমের সংবাদ মিথ্যা ও উদেশ্যেপ্রনোদিত বলে অবহিত করেছিলেন।
তবে গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আলজাজিরার প্রতিবেদনটি অতীতের সব গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে আলাদা। ২৫ মিনিট ১১ সেকেন্ডের এই প্রতিবেদনে বেশ কিছু চমক রয়েছে। আর এই চমকের বেশিরভাগই সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ নিজেই।
আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্যরা চীন থেকে ১০ কোটি ডলার যুক্তরাজ্যের বাজারে স্থানান্তর করতে চান, এ কথা বলে সাইফুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ রিপনের সঙ্গে কথা এগোতে থাকেন। তাঁরা ধনী বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে অভিনয় করে সাইফুজ্জামানের সম্পদের গোপন তথ্য বের করেন।
‘দ্য মিনিস্টারস মিলিয়ন্স’ শিরোনামে আলজাজিরার ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বেশ ভালো সখ্যতা ছিল সাইফুজ্জামানের। যা তিনি নিজেই স্বীকার করে বলেছেন, ‘আমার বাবা শেখ হাসিনার খুব কাছের লোক ছিলেন। আমিও তার কাছের লোক… শেখ হাসিনা আমার বস… তিনি জানেন যুক্তরাজ্যে আমার ব্যবসা আছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত বছর বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে আলজাজিরার সাংবাদিক সাইফুজ্জামান চৌধুরীর লন্ডনের ১৪ মিলিয়ন ডলারের বাড়িতে যায়। নিজের বাড়িও ঘুরিয়ে দেখান তিনি। যেটিতে রয়েছে সিনেমা হল, জিম, ব্যক্তিগত এলিভেটর এবং নতুন রোলস রয়েলস গাড়ি রাখার নিরাপদ আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং এরিয়া।
ওই সময় সাইফুজ্জামান চৌধুরী অনেকটা দাম্ভিকতার সুরে জানান, তিনি উট পাখি ও কুমিরের বুকের চামড়ার তৈরি জুতা পরেন। প্রতি জোড়ার দাম ৬ হাজার পাউন্ডের ওপরে। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য ৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকারও বেশী। আর প্রতি জোড়া জুতা তৈরী করতে সময় লাগে ৪ মাস। শুধু তাই নয়, লন্ডনের সবচেয়ে দামি দোকান থেকে ইতালিয়ান স্যুট তৈরি করে পরেন। পছন্দ করেন রোলস রয়েলস গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে।
আলজাজিরার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন; যা বাংলাদেশি অর্থে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমান। ব্রিটেন ছাড়াও নিজের রিয়েল স্টেট ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত। সব মিলিয়ে তিনি পাঁচশরও বেশি বাড়ি কিনেছেন। যেগুলোর মূল্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৭ সালের দিকে সম্পত্তি কেনা বাড়িয়ে দেন। ২০১৯ সালে যখন তিনি মন্ত্রী হন, তখন এটি আরও বাড়ে।’
আল–জাজিরা অনুসন্ধান বলছে, লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে সব সম্পদ দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। সাইফুজ্জামান সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস থেকে ঋণ নিয়েছেন। ওই ব্যাংকের কর্মী রাহুল মার্টের বর্ণনায়ও সাইফুজ্জামানের সম্পদের বর্ণনা উঠে এসেছে।
সাইফুজ্জামান জানান, তিনি ব্যবসা থেকে তাঁর সব লাভ দুবাই ও লন্ডনে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুবাইয়ের ডাউনটাউনে আমি সেরা সম্পত্তি পেয়েছি। দুবাই মলের কাছে অপেরা এলাকায় আমার খুব সুন্দর একটি পেন্ট হাউস আছে। আমি একটি ভিলাও কিনেছি, যার একটায় ব্যক্তিগত হ্রদ আছে। সবকিছু আছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ম্যানহাটনে খুব সুন্দর বাড়ি আছে। ’
সাইফুজ্জামান আলজাজিরার কাছে দাবি করেছেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব আমিরাতে নিজের বৈধ ব্যবসার মাধ্যমে এই সম্পদ কিনেছেন তিনি।
বাংলাদেশ থেকে এত টাকা কীভাবে আনলেন, এ প্রশ্নের জবাবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমার দুবাইয়ে রিয়েল স্টেট কেনাবেচার ব্যবসা আছে। দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি। তারপর লন্ডন থেকে একটা ঋণ নিই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান দেশের বাহিরের এত পরিমাণ সম্পদ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর নির্বাচনী হলফনামা ও ট্যাক্স ফাইলে গোপন করেছেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার তার বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ এনে তদন্ত শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ এবং তার পরিবারের মালিকানাধীন ইউসিবিএল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/এইচমুন্নী