।।এবিএম সোহেল রশিদ।।
লোক হাসাবেন না, আগুন্তকঃ সেন্সর বোর্ড চাই না। দয়া করে শেষ পেরেকটা মারবেন না, স্বাধীনতার অর্থ চাপিয়ে দেয়া নয়, লালজুলাই থেকে শেখা। আপনারা আমাদের সরকার। আমাদের নিয়ে ভাবুন। চারিদিকে ছি ছি পড়ে গেছে। আপনাদের নিয়ে এতো বিদ্রুপ আমরা সইতে পারি না। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে নিশ্বাস নিতে দিন।
রাষ্ট্রযন্ত্রের মেরামত চলছে। চলচ্চিত্রও বাদ যাবে না এটা সবারই কাম্য। কিন্তু উপদেষ্টা যাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেন, তাঁরা যাদি তাদের ব্যক্তিগত ফ্যান-ফলোয়ার ও অনুসারীদেরকে সুযোগে তালিকায় ঢুকিয়ে দেন, আমরা আশাহত হই। মনে রাখতে হবে এটা রাজনৈতিক সরকার নয়, মেধাবীদের দিয়ে গঠিত স্বৈরাচার বিরোধী ও বৈষম্য বিরোধী সরকার।
অবশ্যই স্বৈরাচারের দোসরকে পুনর্বাসনের সরকার নয়। রক্তের দাগ এখনো যায়নি মুছে। এখনো মৃত্যু তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। আহতরা কাতরাচ্ছে হাসপাতালে, পঙ্গুদের চোখে এক পৃথিবী হতাশা।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করেছে সরকার। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট সেন্সর বোর্ডের সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তারুণ্যের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিগত সরকারের সময়েয় বর্বরোচিত ভাবে নিগৃহীত হয়েছেন এমন নামও আছে। সাধুবাদ জানাই। কর্মকর্তাদের বাইরে সদস্যদের তালিকায় রয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. জাকির হোসেন রাজু, নির্মাতা আশফাক নিপুন, নির্মাতা খিজির হায়াত খান, নির্মাতা তাসমিয়া আফরিন মৌ, নির্মাতা রফিকুল আনোয়ার রাসেল ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ।
প্রশ্ন হলো, উনারা সেইভাবে চলচ্চিত্রাঙ্গনের না হলেও নি:সন্দেহে পরিচিত মুখ কিন্তু চলচ্চিত্রের ঘানিটা যারা দীর্ঘ দিন টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের স্বজন নন, বা হতে পারেননি। শুনতে রূঢ় হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, নাটক ও শর্ট ফিল্ম বানানোর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবেন, পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের দেখভাল করার কাজে, কি অদ্ভুত যুক্তি। তাছাড়া এটা আমাদের অবহেলা।
তারচেয়ে বরং আয়নাঘর পরিত্যক্ত পড়ে আছে, আমরা আর কজন হাজার খানেক, ওখানে নিয়ে আমাদের আটকে রাখুন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমরা মানুষ নই, অন্যকিছু।
এমনিতেই ভালো নাটক নির্মাতারা এসে চলচ্চিত্রের উপস্থাপনটা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা নাটক সিনেমার মাঝামাঝি, এর গতি স্লথ, ভাষা বোধগম্য নয়। দুই-একজন ব্যতিক্রমও আছেন।
চলচ্চিত্রের ক্রান্তিকালে সেন্সর বোর্ডের কাজ শুধু মাত্র খবরদারী আর কাচি চালানো নয়। মতামত, পরামর্শ ও সৌহার্দ্য, গঠনমূলক সমালোচনা, যুক্তি তর্ক ও সহনশীলতার ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যয় থাকতে হবে। নান্দনিকতা ও শিল্পবোধের পাশাপাশি উপমহাদেশীয় ট্রেন্ড, দর্শকের প্রত্যাশার নার্ভ বুঝতে না পারলে পুঁজি লগ্নিকারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ভোক্তা চাহিদা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবশ্যই গল্প, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে শোভনীয় উপস্থাপন একান্ত কাম্য।
আমাদের ধারণা আরেকটু চলচ্চিত্র বান্ধব হয়ে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড ও শিল্পীদের ট্রাস্টি বোর্ডে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ, বয়োজ্যেষ্ঠ, চলচ্চিত্র বান্ধব সুশীল যাদের নখদর্পনে চলচ্চিত্র শিল্প ও বাণিজ্য সেইসব প্রতিশ্রুতিশীলদের প্রতিনিধিত্ব রাখলে খুব একটা কি ক্ষতি হত? আমরা কি আমার কথা, আমার মতো করে, আমার অঙ্গনে বলতে পারব না? এখানে সরকারি টাকায় সিনেমা নির্মিত হয় কয়টি চলচ্চিত্র? মূল পুঁজি আসে বেসরকারি খাত থেকে। তাও আবার এরা পেশাদার চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী নয়। প্রেক্ষাপট বুঝতে হব, এমনিতেই কেউ আর চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করতে চায় না।
সিনেমা হল নেই, আলুপটলের গুদামের মতো যাও দু’একটা এখনো জেগে আছে, কখন যে চোখ বন্ধ করে কে জানে। সিনেপ্লেক্সে চলচ্চিত্র প্রযোজকের কোনো স্বাধীনতা নেই। তার উপর পুঁজি লগ্নিকারীরা সেন্সর বোর্ডকে যদি খড়গ মনে করে, অনভিজ্ঞ মনে করে, সবসময় মাথার উপর যদি কাঁচির ভয় থাকে, তা হলে এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর পরিচালক তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলবে নিশ্চিত। সৃষ্টিশীল কাজে ব্যাঘাত ঘটবেই। তার ওপর নবনিযুক্ত দুইজন সদস্যতো সেন্সর বোর্ডেরই বিরোধী। পদাধিকার বলে একজন আছেন স্বৈরাচারের দালাল।
এদের নিয়ে সেন্সর বোর্ড গঠনের চেয়ে আরো কয়েকজনকে সংশ্লিষ্ট করে সেন্সর বিধিমালা সংস্কার কমিটি গঠন করলে ভালো হতো বলে অনেকে মনে করেন। নিবেদন থাকবে সেন্সর বোর্ড পুন:গঠন করা হোক।
চলচ্চিত্রের অনেকেই সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের অন্তরঙ্গ ভাবে চেনেন না। হয়তো বলবেন চেনার দরকার নেই। আমার দেশ, আমার সরকার অথচ আমি চিনব না। এ কেমন স্বাধীনতা।
আসুন আমরা কয়েকজন সদস্যকে আগে জেনে নেই।
◼️ড. জাকির হোসেন রাজু
একজন বিকল্পধারার নির্মাতা। ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের চেয়ারপারসন ও অধ্যাপক জাকির হোসেন রাজু তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এশিয়ান সিনেমা বিষয়ে পাঠদান ও গবেষণা করছেন। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র গবেষক হিসেবে ফিল্ম স্টাডিজ বিষয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও জাতীয় পরিচিতি’ বিষয়ে ইংল্যান্ডের লন্ডনের রাউটলেজ থেকে ২০১৫ সালে তাঁর একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলচ্চিত্র শিক্ষায় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ছাড়া তিনি পাঁচ বছর ধরে তাঁর শিক্ষার্থীদের ‘কোরিয়ান সিনেমা’ বিষয়ে পড়ান।
এমন একজন শিক্ষাবিদ ও নির্মাতাকে চলচ্চিত্র সংস্কার কমিটিতে কাজে লাগালে অধিকতর ভালো হতো। তিনি একজন প্রথিতযশা শিক্ষক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মূলধারা বা বাণিজ্যিক ছবির সাথে একাডেমিক ছাড়া তাঁর সরব সংশ্লিষ্টতা নেই।
◼️ খিজির হায়াত খান
সেন্সর বোর্ডে মন্দের ভালো সদস্য পরিচালক খিজির হায়াত খান। সাহসী ও প্রতিবাদী। তিনি হ্যামলাইন ইউনিভার্সিটি থেকে আর্টসে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন । ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’ এর মাধ্যমে তার অভিষেক। তিনি ‘জাগো’ চলচ্চিত্রের জন্য সর্বাধিক পরিচিত , যা প্রথম বাংলাদেশী ক্রীড়া চলচ্চিত্র। তিনি তার চলচ্চিত্র ‘ওরা সাত জন’এর জন্য সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার জিতেছেন।
◼️তাসমিয়া আফরিন মৌ
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। পড়ালেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে অডিও ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় কাজ শুরু করেন, প্রথম পরিচালিত প্রামাণ্য-চলচ্চিত্র, ‘রূপান্তরের রূপকথা’। বাংলাদেশে তিনটি টেলিভিশনে সাংবাদিকতা এবং অনুষ্ঠান প্রযোজনার সাথে কাজ করেছেন।
উল্লেখযোগ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ‘কবি স্বামীর মৃত্যুর পর আমার জবানবন্দি’, ‘নায়িকার এক রাত’, ‘পারফর্মার’ এবং প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, ‘টোকাই ২০১২’, ‘বিসর্জন’, ‘তারপর হবো ইতিহাস’, ‘বীর’ ইত্যাদি। তিনি জুরি হিসেবে নেপাল, ভারত এবং মিশরের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর লিখিত প্রথম ছোটগল্পের বই ‘বাক্সবন্দি’ আদর্শ। বর্তমানে প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘কাক’ নিয়ে কাজ করছেন।
কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। সম্ভবত নিজের প্রথম সিনেমা নিজেই সেন্সর করার সৌভাগ্যবতী হবেন।
◼️কাজী নওশাবা আহমেদ (অভিনেত্রী)
নওশাবার এই অন্তর্ভুক্তিতে স্বস্তি প্রকাশ করছেন বেশিরভাগ মানুষই। কারণ তিনি বিগত সরকারের আমলে তুমুল নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। খেটেছেন জেল। সয়েছেন নির্যাতন। হারিয়েছেন কাজ। এমনকি ঠকেছেন শিল্পমাধ্যম থেকেও। সেই শিল্পীকেই এবার রাষ্ট্র বেছে নিলো দেশের সমগ্র শিল্পীর কল্যাণে কাজ করার জন্য! সুবিধাবঞ্চিত কিংবা দুর্গত মানুষ, শিশু ও শিল্পের জন্য কাজ করে আসছেন। অভিজ্ঞতা নেই, সেই অর্থে চলচ্চিত্রের মানুষ নন। তাকে শিল্পকলায় স্বার্থকভাবে কাজে লাগানো যেত।
◼️আশফাক নিপুণ
একজন টেলিভিশন মিডিয়ার পরিচালক ও লেখক। তিনি নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সহকারী হিসেবে টেলিভিশনে যাত্রা শুরু করেন। ২০০৫ সালে নির্মাতা হিসেবে অভিষেক ঘটে। শুরুতে প্রণয়মূলক ও হাস্যরসাত্মক ধারার নাটক নির্মাণ করলেও পরবর্তীকালে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারার নাটক নির্মাণ করে সমাদৃত হন।
তিনি ও তাঁর ওস্তাদ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সেন্সর পদ্ধতিই মানেন না। খাতায় কোনো চলচ্চিত্রের নাম নেই।
◼️মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন (বিশিষ্ট লেখক)
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের জন্ম ঢাকায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক বছর অধ্যয়নের পর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে- নেমেসিস, কন্ট্রাক্ট’, ‘নেক্সাস’, ‘কনফেশন’, ‘করাচি’, জাল’, ‘১৯৫২ নিছক কোনো সংখ্যা নয়’, ‘পেন্ডুলাম’, ‘কেউ কেউ কথা রাখে’, ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ ইত্যাদি। চলচ্চিত্র ভুবনে আনাগোনা থাকলেও পা রাখেননি। বন্ধুর অনুরোধ গিলেছেন মাত্র।
◼️রফিকুল আনোয়ার রাসেল (প্রযোজক ও পরিচালক।
২০২০ সালের ২৭ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রযোজিত রফিকুল আনোয়ার রাসেল নির্মিত ফিচার ডকুমেন্টারি ‘আ ম্যান্ডোলিন ইন এক্সাইল’-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়। তিনি চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, সংগঠক, নির্মাতা। এছাড়া টেলিভিশন, ওয়েব প্লাটফর্মের জন্য কাহিনি ও চিত্রনাট্যরচক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা রফিকুল আনোয়ার রাসেল ভারতের গোয়া আন্তর্জাতিক কো প্রোডাকশন মার্কেট ফিল্মবাজারে তার পূর্ণাঙ্গ সাইকো থ্রিলার কাহিনিচিত্র ‘স্বপ্নচারী’র জন্য ‘প্রডিউসারস ওয়ার্কশপ’ নির্বাচিত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ‘অতিথি শিক্ষক’ ছিলেন।
এক কথায় বলা যায় আওয়ামী লীগের সুবিধা নেয়া, ডকুমেন্টারি নির্মাতা। লালজুলাইয়ের সুবিধাও ভোগ করবেন। কি আর করা।
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও অভিনেতা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান
এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি অবশ্যই BNANEWS এর সম্পাদনা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে না। The views expressed in this article are the author’s own and do not necessarily reflect BNANEWS editorial stance.