বিএনএ, চট্টগ্রাম: এবারের এসএসসি ফলাফলে চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার আটটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে নিচে অবস্থান চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের। এই বিদ্যালয়ের ফলাফল বিপর্যয়ের পেছনে অনেকেই বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে মানসম্মত শিক্ষকের অভাবকে মূল কারণ হিসেবে দুষছেন।
তথ্য বলছে, চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২৪ সালে তিন বিভাগ থেকে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২৮৭ জন, এর মধ্যে পাশ করেছেন ১৭৮ জন, ফেল করেছেন ১০৯ জন। একজন পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁদের পাশের হার ছিলো ৬২.০২%। কোন জিপিএ-৫ নাই। গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার আশঙ্কাজনক ভাবে কমেছে।
এই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বাক্ষরিত ২০২৪ সালের এসএসসি’র বিষয়ভিত্তিক অকৃতকার্যের তালিকায় দেখা গেছে, এবারে ১০৯ ফেলের মধ্যে ইংরেজিতে ফেল করেছে ২১ জন, গণিতে ফেল করেছে ২১ জন, হিসাব বিজ্ঞানে ৩৮ জন, বিজ্ঞানে ৩০ জন, তথ্য ও যোগাযোগে ফেল ১৩ জন।
এছাড়াও ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং-এ ৭ জন, ব্যবসায় উদ্যোগে ৬ জন, ইতিহাসে ৪ জন, ভূগোলে ২ জন, অর্থনীতিতে ১ জন, পদার্থ বিজ্ঞানে ২ জন, রসায়নে ৫ জন, জীব বিজ্ঞানে ১ জন ও ইসলাম ধর্মে ১ জন। আবার অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছেন যারা উভয় বিষয়ে ফেল করেছেন।
একই বিদ্যালয়ের ২০২৩ সালের এসএসসি ফলাফল ছিল ২৮৬ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছিলেন ২১৯ জন, ফেল করেছিলো ৬৭ জন। জিপিএ-৫ ছিল ৫ জন। আর পাশের হার ছিল তখন ৭৬.৫৭%। কিন্তু এবারে ছন্দপতন।
ইনস্টিটিউট ই-রিকুইজিশন অনুলিপি সুত্রে জানা গেছে, এমপিওভূক্ত এই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ ৭ টি বিষয়ের শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। বিষয়গুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, জীব বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, পদার্থ বিজ্ঞান, গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান।
এর মধ্যে দুই বছর যাবৎ পদ খালি বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষকের। জীব বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞানসহ বাকি পাঁচ বিষয়ে শিক্ষক নেই দীর্ঘ ৮ বছর। বলতে গেলে বিজ্ঞান বিভাগ ও আইসিটির কোন এমপিওভুক্ত শিক্ষক নেই এই প্রতিষ্ঠানে।
৮ বছর যাবৎ শিক্ষক না থাকায় অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক দিয়ে কোন রকমে টেনেটুনে পড়াচ্ছেন বলে প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে। হয়তো এর প্রভাব পড়েছে এবারের এসএসসি ফলাফলে। আগের ব্যাচ ভালো করলেও এবারের ফলাফল বলছে, ইংরেজি, হিসাব বিজ্ঞান ও গণিতে ফেল করেছে ৮০ জন। মোট ১০৯ জন ফেলের মধ্যে এ সংখ্যাটি অনেক বড় দেখাচ্ছে।
ওদিকে, চরলক্ষ্যা এলাকার শিক্ষা সচেতন নাগরিকরা জানিয়েছেন মানসম্মত শিক্ষকের অভাবে দিন দিন ফলাফল নিম্নমুখী হচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সভাপতি প্রতিষ্ঠানটিতে যথাযথ সময় দিতে না পারা এবং সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে প্রধান শিক্ষকের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধান এ অভিযোগ মানতে নারাজ।
ফলাফল বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, বিদ্যালয়টি স্বভাবতই পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হতে পারে জিপিএ পদ্ধতির ঠিক উল্টো পথে হাঁটা। যেখানে জিপিএ পদ্ধতিতে সকল বিষয়কে সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা। সেখানে শুধুমাত্র শিক্ষকেরা বেশ কঠিন বিষয়গুলোকে (হিসাব বিজ্ঞান, ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিত) প্রাধান্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে। না হয় ইতিহাস, ইসলাম ধর্ম, তথ্য ও যোগাযোগ এবং ব্যবসায় উদ্যোগের মতো বিষয়ে ফেল করার কথা না। বলতে গেলে বাংলা বিষয়ে অকৃতকার্য বেশি।
এ প্রসঙ্গে চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের মোহাম্মদ আলমগীর নামে এক যুবক তাঁর মন্তব্যে বলেন, ‘সবাই প্রতিষ্ঠান আর শিক্ষকদের কথা বলছি কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের হীনমন্যতা আর অভিভাবকদের উদাসীনতার কথা কেউ বলছি না। একই শিক্ষকদের দ্বারা অনেকে অতীতে দীক্ষিত হয়েছেন। অনেকে এই বিদ্যালয় থেকে শিখরে পৌঁছেছে। ভবিষ্যতে ছাত্র-ছাত্রীদের কন্ট্রোল করা গেলে আবারও আগের মতো সাফল্যের পূনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।’
চরলক্ষ্যা এলাকার চাকরিজীবী রাশেদুল হক রুবেল বলেন, ‘চরলক্ষ্যা স্কুলে পাসের হার কমার কয়েকটি কারণ আছে। তবে এর মধ্যে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হচ্ছে। বিশেষ করে গণিত, ইংরেজি ও হিসাব বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে আরও মানসম্মত শিক্ষক পেলে ফলাফল আরও ভালো করা যেত।’
যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চরলক্ষ্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, ‘ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত ফেল করে গণিত ও ইংরেজিতে। কিন্তু আমাদের স্কুলে অন্যান্য সব নরমাল বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা ফেল করেছেন। যেখানে আমাদের আরো ৪০ থেকে ৫০ ছাত্র-ছাত্রী পাস করার কথা। হয়তো তখন ফলাফল হতো ৮০% এর উপরে।’
এ প্রসঙ্গে চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ আবু তালেব চৌধুরী বলেন, ‘গত বছরে ফলাফলের দিকে কর্ণফুলীতে আমরা ভালো অবস্থানে ছিলাম। এবারে ২৮৭ জন পরীক্ষায় অংশ নিলে ১০৯ জন ফেল করে। বিজ্ঞানে ১৭ জনের মধ্যে ৮ জন ফেল। বাণিজ্যে ৬৬ জনের মধ্যে ৩৮ ফেল করেছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা।’
প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের ৭ টি এমপিওভূক্ত শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। কিছুদিন আগে একজন সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও যোগদান করেনি। ফলে বিজ্ঞানের শিক্ষক পদ শূন্য দীর্ঘ ৮ বছর।’
চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আজিজুর রহমান এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও ফোন রিসিভ না হওয়ায় কোন মন্তব্য জানা যায়নি।
কর্ণফুলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র নাথ বলেন, ‘শিক্ষকের শূন্য পদে ইতিমধ্যে এমপিওভূক্ত শিক্ষক নিয়োগে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। রেজাল্ট খারাপের বিষয়ে আমি সভাপতিকে লিখেছি। আমি আগামী সপ্তাহে স্কুল পরিদর্শন করব। যারা মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য ছিলো, তাদের খাতাগুলো দেখব। কোন কারণে তাদের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।’
তিনি আরও জানান, ‘কর্ণফুলীতে এবার এসএসসিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাশের হার ৭৪.৮৬% ও মাদরাসায় পাশের হার ৮৮.৫৩%। কর্ণফুলীতে এবার এসএসসি পরীক্ষায় ৮ টি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১ হাজার ৮’শ ৫০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১ হাজার ৩’শ ৩১ জন। ফেল করেছে ৪৬৫ জন। পুরো উপজেলায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৩ জন পরীক্ষার্থী।’
প্রসঙ্গত, চরলক্ষ্যা উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী ১৯৭৪ সালে মাধ্যমিক স্তরে সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৪ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়।
বর্তমানে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পাঠদান করে আসছে। প্রধান শিক্ষকও সহ প্রধানসহ এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন ১২ জন। এছাড়াও নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন আরও ৫ জন। মোট ১৭ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন।
বিএনএনিউজ/ বিএম/হাসনা