18 C
আবহাওয়া
১২:৫১ পূর্বাহ্ণ - ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » বঙ্গবন্ধু টানেল : ২০০৮ সালে লালদিঘীতে শেখ হাসিনার ওয়াদা, ২০২২ সালে বাস্তবায়ন

বঙ্গবন্ধু টানেল : ২০০৮ সালে লালদিঘীতে শেখ হাসিনার ওয়াদা, ২০২২ সালে বাস্তবায়ন


বিএনএ চট্টগ্রাম, মনির ফয়সাল : ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে আসেন। তিনি লালদিঘী মাঠের বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হবে টানেল। চীনের সাংহাইয়ের ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ আদলে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলা হবে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি চট্টগ্রাম তথা দেশের অনেক মানুষ। সমালোচনা করে অনেকে মন্তব্য করেছেন নদীর তলদেশে রাস্তা নির্মাণ সম্ভব? জনগণকে ধোকা দিয়ে ভোট নেয়ার জন্য এমন ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। ২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হন।  প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী কর্ণফুলী নদীতে  প্রথম টানেল নির্মাণের দাবি  করেন।নদীর মরফলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমা একটি বড় সমস্যা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারীতার জন্য বড় হুমকি। এই পলি জমা সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর আর কোন সেতু নির্মাণ না করে এর তলদেশে টানেল নির্মাণ করার দাবি জানান মহিউদ্দিন চৌধুরী।

২০১৪ সালে কর্ণফুলীতে টানেল প্রকল্প গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ সফরকালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি চিনপিং  কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এ টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। যা এখন দৃশ্যমান। ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায়।পরবর্তীতে কর্ণফুলী টানেলের নামকরণ করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’।

বাংলাদেশ সরকার ও চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক যৌথভাবে অর্থায়ন করছে প্রকল্পটিতে। চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি নির্মাণ করছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা।এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ। পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্তে স্থাপন করা প্রথম টিউবের ভেতরে গাড়ি চলাচলের জন্য পিচঢালা সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। একই সাথে দ্বিতীয় টিউব তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় টিউবের প্রায় ২৫০ মিটার বোরিং কাজ শেষ হয়েছে।

আগামী ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র টানেল দেশ হিসাবে গ্রিনিচ বুক রেকর্ডে নাম লেখাবে বাংলাদেশ। এটি যুক্ত হবে ট্রান্স এশিয়া সড়কের সঙ্গে। কক্সবাজারের সঙ্গে কমবে ৪০ কিলিমিটার দুরত্ব। সেই সঙ্গে বাস্তবায়ন হবে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ পরিকল্পনা। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম- কক্সবাজারে গড়ে ওঠছে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারায় গড়ে উঠেছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড)। এ টানেলের মধ্য দিয়ে দু’পাড়ের সেতুবন্ধন রচিত হবে। শিল্পায়নের ফলে এ অঞ্চলের লাখো মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। টানেল ঘিরে এখনই ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পকারখানার স্থাপনের জন্য জমি কিনতে শুরু করেছেন। আগে থেকে কোরিয়ান ইপিজেড এ পুরোদমে চলছে শিল্পায়ন কর্মকান্ড। একই সঙ্গে শঙ্খ নদী মোহনা এলাকায় গড়ে উঠছে বেসরকারি বিভিন্ন মেগা শিল্প কারখানা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় , গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আনোয়ারা প্রান্ত থেকে টানেলের দ্বিতীয় টিউব নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রথম টিউব থেকে ১২ মিটার দূরে নির্মাণ করা হচ্ছে শেষ টিউবটি। মাটির ১৮ মিটার থেকে ৪৩ মিটার নিচ দিয়ে যাবে টানেল বোরিং মেশিন। এছাড়া টানেলের শক্ত দেয়াল হিসেবে ২০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট স্থাপন করা হবে দুটি টিউবে। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিংজিয়ান শহরে টানেলের সেগমেন্টগুলো তৈরি হচ্ছে। জাহাজে করে এনে তা তলদেশে স্থাপন করে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ৮টি সেগমেন্টে দুই মিটারের একটি রিং তৈরি করে। বর্তমানে টানেল নির্মাণে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ১০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট স্থাপন করে প্রথম টিউব তৈরি করা হয়েছে।

কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সড়ক তৈরির কাজ চলছে। ইতোমধ্যে টানেলের পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্ত পর্যন্ত একটি টিউবের নির্মাণ শেষ হয়েছে। আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত আরেকটি টিউবের কাজ চলছে। প্রথম টিউবের ভেতরে পতেঙ্গা অংশে আরসিসি ঢালাই দিয়ে ইন্টারনাল স্ট্রাকচার তৈরির পাশাপাশি দ্বিতীয় টিউব বোরিং এর কাজ পুরোদমে চলছে।

৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মূল টানেলের সাথে উভয় প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হবে। নদীর তলদেশে এর গভীরতা হবে ১৮ থেকে ৩১ মিটার। চার লেনের টানেলে দুটি টিউব থাকবে। টানেলের ভিতরে দুটি টিউবে ওয়ানওয়ে গাড়ি চলবে। একটি দিয়ে শহর থেকে আনোয়ারামুখী গাড়ি যাবে, অপরটি দিয়ে আনোয়ারা থেকে শহরমুখী গাড়ি আসবে। প্রতিটি টিউব ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট চওড়া এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট।

কর্ণফুলীর শিকলবাহা ওয়াই জংশন (ক্রসিং) থেকে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত সড়কটি ছয় লাইনে প্রশস্ত হচ্ছে। বর্তমানে দুই লাইনের ১৮ ফুটের সড়কটি হবে ১৬০ ফুট। সাড়ে ১১ কিলোমিটার এই সড়ক নির্মাণে ব্যয় হবে ২৯৫ কোটি টাকা।

বঙ্গবন্ধু টানেল চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তের নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া টানেলটি নদীর দক্ষিণ পাড়ে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড (কাফকো) সার কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে ১৫০ ফুট গভীরে অবস্থান করবে ।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে সিটি আউটার রিং রোড দিয়ে পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলে প্রবেশ করে আনোয়ারা প্রান্তে পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়কের চাতুরী চৌমুহনী পয়েন্টে ওঠা যাবে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে।এটিই হবে বাংলাদেশ এর প্রথম টানেল পথ।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পরিচালিত বঙ্গবন্ধু টানেলের চার লেইন ১০ কি.মি. সড়কের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ পর্যায়ে। টানেলের টিউবসহ ৩০ মিটার প্রস্থ এ সড়কে কাফকো সেন্টার-কান্তিরহাট থেকে জেলেঘাটা পর্যন্ত ৭৫০ মিটার ফ্লাইওভার হবে। এ সড়কের দুপাশে ড্রেন নির্মাণের পাশাপাশি সবুজায়নের ব্যবস্থাও রয়েছে। ৩০ মিটার প্রস্থ সড়কের মূল অংশ হবে ২৪ মিটার। এ সড়কের প্রথম অংশ হতে ৪ মিটার উচ্চতা হয়ে পরবর্তীতে ২ মিটার পর্যন্ত উচ্চতা থাকবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্ণফুলী টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে। এ টানেল মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করবে। আবার টানেলের কারণে সহজ যোগাযোগের ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামেও নতুন নতুন আরও শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এরই মধ্যে টানেলকে কেন্দ্র করে আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও বাঁশখালী উপজেলায় নতুন নতুন কারখানা তৈরির পরিকল্পনা করছেন উদ্যোক্তারা।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের আমদানি-রপ্তানি পণ্য টানেল দিয়ে পরিবহন হবে। তাতে বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। ফলে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।

বাংলাদেশ বাঙ্কার সাপ্লাইয়ার্স এসোশিয়েন সভাপতি মিজানুর রহমান মজুমদার বলেন, কর্ণফুলীতে টানেল নির্মিত হলে এলাকার আশে পাশে শিল্পোন্নয়ন , পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে । ফলে দারিদ্র দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। জিডিপি তে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে এবং পূর্বপ্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল, প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হবে।বিকশিত হবে পর্যটনশিল্প।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, টানেলটি চালু হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে পর্যটন বা অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে স্থাপিত শিল্পকারখানার পণ্য যেমন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া সহজ হবে তেমনি মাতারবাড়ী বন্দর হলে সারা দেশের পণ্য এই টানেল দিয়ে আনা-নেওয়া করা যাবে।

টানেল সড়কের আনোয়ারা অংশের সঙ্গে পারকি বিচের লিংক রোড স্থাপন করা হলে পতেঙ্গা থেকে পারকিতে সহজে পর্যটকরা যেতে পারবে:

 

আনোয়ারা উপজেলার বারশত ইউপি চেয়ারম্যান এম.এ কাইয়ূম শাহ্ বলেন, দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু টালেন বড় প্রকল্প। এটির কাজ শেষ হলে আনোয়ারার মানুষ উপকৃত হবে। তেমনি উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে বারশত ইউনিয়নের মানুষদেরও। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বড় পর্যটন কেন্দ্র পারকি সমুদ্র সৈকত। সৈকতের পর্যটকদের জন্য যদি টালেন সড়ক ব্যবহারের জন্য একটি  লিংক রোড করে দিলে পর্যটকরা সহজে পারকি সৈকতে বিনোদনের সুযোগ পাবে। সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত পাবে পারকি বিচ।

বিএনএ/ মনির/ এসজিএন/ ওয়াইএইচ

Loading


শিরোনাম বিএনএ