বিএনএ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক ও স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি, স্বাস্থ্য সনদ প্রদানের নামে অর্থ আদায় এবং ব্যবসায়ীদের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। রয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে বিভিন্ন দোকান ও কারখানা থেকে রসিদবিহীন অর্থ আদায়ের।
ব্যবসায়ীদের দাবি, তিনি মাসোহারা আদায়ের জন্য একটি গোপন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পরিচালনা করেন, যেখানে ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযান সম্পর্কে আগাম তথ্য সরবরাহ করেন। অনেকে জানিয়েছেন, এই গ্রুপে কর্ণফুলীর অনেক বড় খাদ্য কারখানা ও দোকানপাটের মালিক যুক্ত রয়েছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মনোয়ারা বেগম মাসে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন। তিনি উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে বিভিন্ন হোটেল, বেকারি, চায়ের দোকানসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সনদের নামে অর্থ আদায় করেন।
মইজ্জ্যারটেক এলাকার এক বেকারি ম্যানেজার জানান,“আমাদের স্টাফদের স্বাস্থ্য সনদ বাধ্যতামূলক বলে দাবি করে তিনি ৬-৭ হাজার টাকা আদায় করেন। এছাড়া চাঁদা না দিলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ভয় দেখান।”
তথ্য অনুযায়ী,‘কর্ণফুলী ফুড অ্যান্ড বেকারি অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে তিনি ব্যবসায়ীদের ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানের আগাম তথ্য জানিয়ে দেন। প্রতিবেদকের হাতে পাওয়া স্ক্রিনশট থেকে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে তাদের সতর্ক করেছেন।
অতীতে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আসায় তাকে বদলি করা হলেও তিনি পুনরায় কর্ণফুলীতে ফিরে আসেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, তিনি প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বদলি ঠেকিয়ে এখানেই টিকে থাকেন।
বিভিন্ন ডেইরি ফার্ম, রেস্টুরেন্ট, বেকারি ও চায়ের দোকানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে কথিত স্বাস্থ্যসনদ প্রদানসহ উপজেলার কয়েক শতাধিক দোকানপাট ও হোটেল মালিকদের কাছ থেকে প্রিমিসেস লাইসেন্সের নাম দিয়ে রসিদ ছাড়া অর্থ আদায়ের অভিযোগও অনেক পুরনো।
যদিও অতীতে এ ধরনের নানা অভিযোগ আসায় বিতর্কিত এই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে কয়েকবার অন্যত্রে বদলি ও শোকজ করা হলেও ঘুরে ফিরে জেলা সিভিল সার্জন ও জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তিনি পুনরায় কর্ণফুলীতে বহাল রয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় ৫ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি কর্ণফুলীতে কর্মরত রয়েছেন।
যে সব প্রতিষ্ঠা থেকে সুবিধা নিচ্ছেন বলে প্রচলন রয়েছে-মাসুদ এগ্রো (বাংলাবাজার ঘাট), কিষোয়ান (কর্ণফুলী), বনফুল (মইজ্জ্যারটেক-ব্রিজঘাট), জে.বি. ওয়েল (চরপাথরঘাটা), স্মার্ট গ্রুপ (বোর্ড বাজার), নুর সুইটস (মইজ্জ্যারটেক), তিস্তা ফুড (তোতার বাপের হাট), মিষ্টিমেলা (সিডিএটেক) রসালো (সৈন্যেরটেক), ইয়াছিন বেকারি (কর্ণফুলী) হাসান বেকারী (জুলধা পাইপের ঘোড়া), ফ্রেশ এ্যান্ড সেইফ (ব্রীজঘাট), বগুড়ার দই (মইজ্জ্যারটেক), আধুনিক বেকারী (কলেজবাজার), বার আউলিয়া বেকারী (কর্ণফুলী), আনোয়ার বেকারী (মাষ্টার হাট), ইলিগান বেকারী (টুলবক্স), হোসেন ফুড (সৈন্যেরটেক), আয়েশা বেকারি (খুইদ্যারটেক), মায়ের দোআ (কর্ণফুলী), আলিফ বেকারি (বিএফডিনি রোড), নয়ন বেকারি (তোতারবাপের হাট), আনোয়ার পুষ্টি বেকারি (টুলবক্স), টুস্টার বেকারি (কালাইয়্যার দোকান), কর্ণফুলী বেকারি (ওভারব্রিজ) ও নুরী বাবা বেকারি (বোর্ড বাজার)।
এছাড়াও বিজয় দিবস উদযাপনের নামেও কি কি জানি ঘটাচ্ছে বলে পুরো উপজেলা জুড়ে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরো তথ্য মিলে, কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়নের সমস্ত বাজারে ও দোকানে স্যানেটারি ইন্সপেক্টর মনোয়ারা বেগমের হয়ে মাসিক মাসোহারা আদায় করতেন তার কথিত ছোট ভাই মো. রায়হান নামে এক কিশোর।
জানা গেছে, স্যানিটারী ইন্সপেক্টর মনোয়ারা বেগম ২০১৯ সালে থেকে কর্ণফুলী উপজেলায় কর্মরত। যদিও তার কর্মপরিধির মধ্যে রয়েছে উপজেলা ভিত্তিক খাদ্য স্থাপনা পরিদর্শন, দৈনন্দিন রিপোর্ট প্রদান, খাদ্য নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাবে প্রেরণ, নমুনা ভেজাল হলে আদালতে মামলা দায়ের, পঁচা-বাসি ও মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্যপণ্য জব্দ এবং ধ্বংস করা, সংক্রামক ছোঁয়াচে রোগের কারণ অনুসন্ধান, স্কুল ও কমিউনিটিতে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা ইত্যাদি।
এই স্যানেটারী ইন্সপেক্টরকে আবার ব্যবসায়ীদের অনেকেই ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জানেন। স্যানিটারি ইন্সপেক্টর নিজেও নাকি অনেক জায়গায় নিজেকে ম্যাজিস্ট্রেট বলে জাহির করেন। তবে স্বাধীনভাবে সে তথ্য যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্ণফুলীর মইজ্জ্যারটেক এলাকার এক বেকারি ম্যানেজার জানান, ‘দোকানে ৫ জন স্টাফ থাকলে তাঁদের বাৎসরিক স্বাস্থ্যগত সনদ লাগবে বলে ৬-৭ হাজার টাকা নিয়ে যেতেন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। তিনি সব খাবার দোকানদারদের সাথে এ রকম করছে। এর থেকে আমরা মুক্তি চাই।’
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, এই ইন্সপেক্টর ২০১৯ সাল থেকে একই উপজেলায় কর্মরত রয়েছেন এবং তাকে অন্যত্র বদলি করার পরও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুনরায় বহাল হয়েছেন।
এসব সমস্ত অভিযোগের বিষয়ে স্যানিটারী ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক মনোয়ারা বেগম জানান, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আর যে ছেলের কথা বলতেছেন আমাকে টাকা তুলে দেয়। তার তো চাকরি হয়েছে।
কর্ণফুলী উপজেলা মেডিকেল অফিসার ডা. আরমিন সুলতানা আঁখি বলেন, আসলে বিষয় গুলো আমি জানি না। আর এসব বিষয় নিয়ে অফিস প্রদানের সাথে যোগাযোগ করলে ভালো হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা (ইউএনও) মাসুমা জান্নাতের মুঠোফোনে কল করা হলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারহান ইসলাম চৌধুরী বলেন, লিখিত কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই সেটির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কিন্তু গত ৬ বছরে এত অভিযোগ থাকার পরও কি ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দেননি জেলা খাদ্য কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রিমিসেস লাইসেন্সের সরকারি ফি ১শ টাকা তাঁর মধ্যে চালান ফি ৫০ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। কেউ এ বিষয়ে ক্যাশে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। স্যানেটারী ইন্সপেক্টরের কাজ এসব নয়। এ বিষয়ে আমি খোঁজ খবর নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবো।’
বিএনএনিউজ/ বিএম