বিএনএ, চুয়েট : চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলে ডাইনিংয়ে খাবার না পাওয়াকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কুদরত-ই-খুদা (কিউকে) হলে এ ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, গত বুধবার ডাইনিংয়ে দুপুরের খাবারে ডাল না পেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কিউকে হলের একটি গ্রুপে পোস্ট করেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের হোসেন খান। পরে এ নিয়ে হলের ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মেসেঞ্জার গ্রুপে দুই পক্ষের মধ্যে বাক-বিতন্ডা হয়। পরে এ ঘটনার সমাধান এবং পূর্ব নির্ধারিত কিউকে হলের প্রভোস্ট ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনার আগে পূর্ব প্রস্তুতি নিতে সভার আহবান করেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল (সিএসই) বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাফসান বিন আলী ও অন্যান্যরা। সভায় আলোচনার এক পর্যায়ে এ সংঘর্ষের ঘটে। এ ঘটনায় ফেসবুকে পোস্টদাতা জুবায়ের হোসেন খান ও একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী তারিকুল ইসলাম মেসবাহ আহত হন।
ভুক্তভোগী জুবায়ের হাসান খান বলেন, গত বুধবার দুপুরের খাবারে ঘন ডাল না পেয়ে সে বিষয়ে কিউকে হলের ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করি। এরপর হলের ডাইনিং ম্যানেজাররা আমার কাছে এসে দুঃখ প্রকাশ করে এবং তখন আমাদের মধ্যে হলের ডাইনিংয়ের মান উন্নয়নের ব্যাপারে গঠনমূলক আলোচনা হয়। কিন্তু তারপরেও এ বিষয়ে আমি পোস্ট না দিয়ে কেন আগে ম্যানেজারের সাথে কথা বলি নাই এ নিয়ে কয়েকজন মেসেঞ্জার গ্রুপে প্রশ্ন তুলে এবং বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে। তখন আমাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডার সৃষ্টি হয়। এরপরে পূর্ব নির্ধারিত কিউকে হলের প্রভোস্ট ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনার পূর্ব প্রস্তুতি এবং এ ঘটনার ব্যাপারে আলোচনা করতে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি(সিএসই) বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাফসান বিন আলী ও অন্যান্যরা একই দিন(বুধবার) রাতে মিটিং আহবান করে। বুধবার বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা থাকায় মিটিংটি বৃহস্পতিবার রাতে নির্ধারিত হয়। এর আগে আমরা যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমাদের বিভাগের তিন জনকে বয়কট করি। এদের মধ্যে একজন কিউকে হলের আশিকুল ইসলাম তামিম। বৃহস্পতিবার দুপুরে ডাইনিংয়ে আমার বন্ধু যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতান হোসেন লাবিবের সাথে ইলেক্ট্রনিক এন্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের শিক্ষার্থী রায়হান জাভেদের দেখা হয় এবং সে আমার করা পোস্টের কমেন্টে কেন হাহা রিয়েক্ট করেছে তার জবাবদিহিতা চায় এবং আশিকুল ইসলাম তামিমকে ছাত্রলীগ আখ্যা দিয়ে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার জন্য প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া সে তামিমের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ দেখাতে পারবে কি না জানতে চায়। বৃহস্পতিবার সভায় আলোচনার এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে ইলেক্ট্রনিক এন্ড টেলিকমিউনিকেশন(ইটিই) বিভাগের রায়হান জাবেদ আমার দিকে তেড়ে আসে। পরবর্তীতে অন্যদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হলেও কিছুক্ষন পর আবার রাফসান বিন আলীর উস্কানিমূলক কথায় পরিস্থিতি পুনরায় উত্তপ্ত হয়। এসময় পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন, রায়হান জাবেদসহ আরো কয়েকজন আমাদের দিকে তেড়ে আসলে হাতাহাতি শুরু হয় এবং একপর্যায়ে তারা আমাকে টেনে নিয়ে মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দেয়।
আরেক ভুক্তভোগী তারিকুল ইসলাম মেসবাহ বলেন, হামলাকারীদের থেকে জুবায়েরকে সরানোর সময় হঠাৎ ইমরান আরেকটা কই, আরেকটা কই বলে চেঁচিয়ে উঠে এবং আমার মাথায় প্লেট দিয়ে প্রচন্ড জোরে আঘাত করে। এতে প্লেটটি ভেঙে গুড়ো হয়ে যায়।
এ ঘটনার পরপর হলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাদেরকে চুয়েট মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায় এবং সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। তারিকুল ইসলাম মেসবাহ তেমন গুরুতর আহত না হলেও জুবায়ের হোসেন খানের নাকের হাড় ভেঙে গেছে বলে জানা যায়।
ভুক্তভোগীরা আরো জানান, তাদের উপর হামলাকারীরা পূর্বে ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং অতীতে বিভিন্ন সময়ে তাঁরা লাঠি-সোঁটা হাতে অন্য হলের সাথে মারামারিতেও যুক্ত ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাফসান বিন আলী জানান, মিটিং এ শুরু থেকেই জুবায়ের আগ্রাসী আচরণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে আমাকে স্বৈরাচারী বলে আখ্যায়িত করে। এতে উভয়পক্ষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ফলশ্রুতিতে এই দূর্ঘটনাটি ঘটে।
ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ততার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কখনো রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। বরং গত ৩ আগষ্ট কুমিল্লায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আমি ও আমার বন্ধুরা ছাত্রলীগের গুলির তোপের মুখে পরেছিলাম।
অভিযুক্ত আরেক শিক্ষার্থী রায়হান জাবেদ জানান, মিটিং এ জুবায়ের ও মেসবাহ আমাদের উপর একের পর এক মিথ্যা দোষারোপ করতে থাকে। আমরা তার যথাযথ উত্তর দিয়ে কিছু প্রশ্ন করলে, তারা তার উত্তর দিতে না পেরে আরো আগ্রাসী আচরণ করতে থাকে। এমন সময় দুই পক্ষই উত্তপ্ত হয়ে যায় এবং হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। তারই সূত্রধরে এক পর্যায়ে তা মারামারিতে রূপ নেয়। তবে, এটা ইচ্ছাকৃত কোনো আক্রমণ ছিল না। ঘটনাপ্রবাহের ফলাফল ছিল।
ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ততার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, আমি ছাত্রলীগের নই বরং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। গত ৩ আগস্ট এই আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে আমি তিনটি রাবার বুলেটের আঘাতের স্বীকার হয়েছি।
অভিযুক্ত পুরকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন জানান, তাদের আগ্রাসী আচরণ এবং কথাবার্তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এমন অবস্থায় মেসবাহ স্থান ত্যাগ করতে চাইলে আমি তাকে আটকানোর জন্য তার দিকে প্লেট নিক্ষেপ করি। কিন্তু তা অনিচ্ছাকৃতভাবে দূর্ঘটনাবশত তার মাথায় আঘাত করে। ছাত্রলীগের সাথে আমি কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই।
কিউকে হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. আরাফাত রহমান জানান, ঘটনার পরপই আমি মেডিকেল সেন্টারে যেয়ে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে দুই পক্ষই উপস্থিত ছিল। আগামী রবিবার আমরা আলোচনায় বসবো। তখন এ সমস্যার একটি সুষ্ঠু সমাধান বের করা হবে।
এ ঘটনার ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাইফুল ইসলাম জানান, এই বিষয়ে ওদের একটি গ্রুপের সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি তাদেরকে লিখিত অভিযোগ করতে বলেছি। বিষয়টিকে আমরা গুরুত্বের সাথেই দেখছি। ওদের অভিযোগ সাপেক্ষে সকল হলের প্রভোস্ট এবং ডিনদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিএনএনিউজ/ইয়াসির/এইচ.এম/ হাসনা