বিএনএ, ডেস্ক : জুলাই আন্দোলনে জড়িত রাজনৈতিক দলের প্রধানদের নিয়ে গত ৫ আগষ্ট বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় রাষ্ট্রীয়ভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। কিন্তু এই ঘোষণাপত্রে জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি বলে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন সরকারি দল খ্যাত জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি। কিন্তু দলটি এই ঘোষণাপত্রের সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন। এমন কী ঘোষণাপত্র পাঠের দিন ক্ষোভে, অপমানে, অভিমানে এনসিপির প্রথম সারির ৫ নেতা, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা ভাবতে চলে গেছেন সুদূর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে!
দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সমালোচনায় মূখর তখন অনেকটা আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন এক সময়কার আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান।
ফেসবুক পোস্টে বার্গম্যান লিখেছেন, ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা ইতিহাসের বেশির ভাগ অংশ—একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নিয়ে বর্ণনা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট ও একতরফা। যাঁরা আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করেন, এতে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রের অনেকটাই পড়ে মনে হয়, যেন এটি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিরোধী ও সমালোচকদের লেখা একটি রাজনৈতিক বক্তব্য।
সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে এই ঘোষণাপত্রে যে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক বয়ান তুলে ধরা হয়েছে, তা ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক ইতিহাস ব্যবহার করেছিল, তার চেয়ে বেশি সমস্যাজনক হতে পারে। এই ঘোষণাপত্র অতিমাত্রায় পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক একটি ইতিহাসের বর্ণনাকে সরিয়ে, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আরেকটি বর্ণনাকে প্রতিষ্ঠা করছে।
বার্গম্যান আরও লিখেন—ঘোষণাপত্রে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনকালকে শুধু একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। যুদ্ধপরবর্তী জাতি গঠনে আওয়ামী লীগ যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল, সেগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে।
এতে বরং ১৯৭১–পরবর্তী ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার’ দায় ‘সংবিধানের খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া ও কাঠামোর দুর্বলতার’ ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগের যতটা সফল হওয়ার কথা ছিল, ততটা না হওয়ার পেছনে নিঃসন্দেহে অনেক কারণ রয়েছে। তবে আমি কখনোই শুনিনি, সংবিধানের ‘খসড়া তৈরি’ ও ‘কাঠামো’ সেসব কারণের একটি।
ঘোষণাপত্রে ১৯৭৫ সালের আগস্টে সেনাসদস্যদের হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের ১৬ জন সদস্যের হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসন শুরু হয়েছিল।
ঘোষণাপত্রে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত মুজিব–পরবর্তী সময়ে যখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন, ওই সময়টাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। আর এটাকে সাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব’ হিসেবে, যা ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের’ পথ সুগম করেছিল। এটি সেই সময়ের অতিমাত্রায় বিএনপিপন্থী বর্ণনা।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘১/১১’—যখন ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সরিয়ে সামরিক বাহিনী–নিয়ন্ত্রিত সরকার এসেছিল, তা ছিল ‘ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার’ ফল । প্রকৃতপক্ষে এটি হয়েছিল বিএনপি সরকার যখন নির্বাচনে কারচুপি করার চেষ্টা করছিল। আর এই কারচুপি থামানোর একমাত্র পথ ছিল সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ। দৃশ্যত সে সময় এ সিদ্ধান্ত খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
ঘোষণাপত্রের আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে ১/১১–এর পেছনের ‘ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল। তবে ২০০৯ সালের নির্বাচনে কিছু কারচুপির ঘটনা ঘটলেও এই নির্বাচনকে সাধারণত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনগুলোর একটি হিসেবে দেখা হয়। সে সময় স্পষ্টভাবেই আওয়ামী লীগ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় দল।২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি তাদের সুনাম হারিয়েছিল—বলেন সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল তা উল্লেখ না করে ঘোষণাপত্রে এই ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে দলটি ‘ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী’ ছিল । এটি একেবারেই অসত্য। বাস্তবতা হলো, ক্ষমতায় থাকার সময় যতই গড়িয়েছিল, ততই অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
ডেভিড বার্গম্যান তার ফেসবুকে উল্লেখ করেন, ঘোষণাপত্রে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনকালকে সম্পূর্ণরূপে একটিমাত্র দিক দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের উপস্থাপন কোনো বৈধ নথির চেয়ে সাধারণত বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রচারণামূলক লেখায় দেখা যায়। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঘোষণাপত্রে এই বিশেষণগুলো ব্যবহার করা হয়েছে: ‘গণবিরোধী’, ‘স্বৈরাচারী’, ‘মানবাধিকারবিরোধী’, ‘মাফিয়া ও ব্যর্থরাষ্ট্র’, ‘সীমাহীন দুর্নীতি’, ‘ব্যাংক লুট’ এবং অনুসরণ করা নীতিগুলো ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করছে’। এই বর্ণনাগুলোর কয়েকটি অবশ্যই সত্য।
কিন্তু ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগের অন্য আরেকটি দিক পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নারীশিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছিল তারা। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালে একই সঙ্গে দুটি বয়ানই ছিল। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক বয়ানগুলোকে ছাড়িয়ে যায় নেতিবাচক বয়ান।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে ‘যেহেতু শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় ষোলো বছর যাবৎ নিরন্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে জেলজুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।’ ঘোষণাপত্রে বর্ণনা করা এসব ঘটনা ঘটেছিল, তবে এখানে যেভাবে অতিরঞ্জিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেভাবে ঘটেনি।
ঘোষণাপত্রের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যুক্তরাজ্যের এই সাংবাদিক আরও লিখেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে ২০২৪ সালের ৮ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া মতামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেটি অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈধতা দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে । তবে আমার জানামতে, স্বাক্ষরকৃত ওই আদেশ কেউ দেখেননি। এ থেকে বিচারকেরা আদৌ কখনো স্বাক্ষর করেছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যদিও এটা ঠিক যে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে ‘আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র ও জনতাকে’ ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার শিকার হওয়া থেকে একধরনের ‘আইনি সুরক্ষা’ দেওয়া উচিত , তবে শব্দের ব্যবহার দেখে মনে হয়েছে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ‘আইনের শাসনের’ দিক দিয়ে এখানে সমস্যা রয়েছে, যে আইনের শাসন বাংলাদেশের মানুষ আশা করে বলে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।’ এমন একটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতমূলক দলিল যদি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে তা অবশ্যই লজ্জাজনক হবে বলে উল্লেখ করে বার্গম্যান।
ঘোষণাপত্রের কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে বলে উল্লেখ করেন সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। বিশেষ করে: এটি ১৯৭১–কে জাতির ইতিহাসে ন্যায্য স্থান দিয়েছে এবং বলেছে যে লড়াইটি ছিল একটি ‘উদার গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের জন্য।
এটি আন্দোলন ও অভ্যুত্থানকে বেশ নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেছে। বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ভালোভাবে তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, তারা ‘সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং সব রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের’ অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
একই সঙ্গে ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে’।
ডেভিড বার্গম্যান তার বিশ্লেষণে বলেছেন, সব মিলিয়ে, এটা উল্লেখযোগ্য যে অধ্যাপক ইউনূস, যিনি দলীয় রাজনীতিতে জড়িত না থাকার সুবিধাজনক অবস্থান থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে এসেছিলেন, তিনি এই ঘোষণাপত্রে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছেন।
এক সময়কার আওয়ামী লীগের হয়রানিমূলক মামলার শিকার সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান তার ফেসবুক পোস্টে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, কে জানে নির্বাচনের পর অধ্যাপক ইউনূসের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? তবে অনেকের মতে, এই ঘোষণাপত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্পৃক্ততা তাঁর এককালের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতো হবে!
সৈয়দ সাকিব