।।সিরাজুল আরেফীন চৌধুরী।।
মাজার একটি আরবি শব্দ, ফার্সীতে বলা হয় দরগাহ। মাজার বলতে বোঝায় জিয়ারতের স্থান। মাজার মূলত কবর। প্রশ্ন হল কবরকে মাজার বলা হয় কেন? প্রচলিত অর্থে সকল কবরকে মাজার বলা হয় না। মানুষ যখন কবরকে কেন্দ্র করে জিয়ারত করতে থাকে, মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়, স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক জিয়ারত করতে থাকে- তখন সেটা মাজার হয়ে যায়। মূলত অধিক জিয়ারতের কারণে মাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
সুফি-সাধকগণ উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন
আমাদের এই উপমহাদেশে কোন নবী-রাসুল সরাসরি এসে ইসলাম প্রচার করেননি। আরব দেশ থেকে সুফি-সাধকগণ এসে এদেশে ইসলামের বাণী প্রচার করেন। সুফি-সাধকগণ উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, সব সময় এবাদতে মগ্ন থাকতেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের উপকার করতেন। তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় চলে আসে।
মাজার সমূহ ইসলামী ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন
এই সুফি আউলিয়াগণের ইন্তেকালের পরে তাদের হাতে দীক্ষিত মুসলমানগণ শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী তাদের কবর জিয়ারত করতেন। কালক্রমে জিয়ারত করার মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং জিয়ারত করার সুবিধার্থে কবরকে কেন্দ্র করে ঘর নির্মাণ করা হয় যাকে মাজার বলা হয় প্রচলিত অর্থে। অবশ্য শুধু বাংলাদেশে বা ভারতীয় উপমহাদেশে মাজার আছে তা নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশ্বের আনাচে-কানাচে অনেক পীর-আউলিয়ার মাজার রয়েছে। এই মাজার সমূহ ইসলামী ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। মানুষ বিপদে-আপদে মাজারে গিয়ে আল্লাহর অলির উছীলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এবং তাদের বিশ্বাস আল্লাহর অলির উছীলায় আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন।
ইসলাম প্রচারকে কেন্দ্র করে প্রাচীন মাজার সমূহ গড়ে উঠেছে
মূলত ইসলাম প্রচারকে কেন্দ্র করে প্রাচীন মাজার সমূহ গড়ে উঠেছে। এ কারণে অধিকাংশ মাজারের সাথে মসজিদ স্থাপিত হয়েছে যেখানে মুসলমানগণ নিয়মিত নামাজ আদায় করে থাকেন। এদেশের প্রাচীন মাজার সমূহের মধ্যে সিলেটের হযরত শাহজালাল ইয়ামেনি, শাহপরান, রাজশাহীর মকদুম শাহ, বাগেরহাটের খান জাহান আলী, চট্টগ্রামের বার আউলিয়া, গরীবুল্লাহ শাহ, আমানত শাহ, শাহ মোহছেন আউলিয়া, বদর শাহ, কালু শাহ, মিসকিন শাহ-র মাজার ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মাজারে শুধু মুসলমানগণ যায় তা নয়
সময়ের পরিক্রমায় পরবর্তীতে আরো অনেক মাজার গড়ে উঠে বাংলার আনাচে-কানাচে। (অবশ্য কিছু ভন্ড মাজারও স্থাপিত হয়েছে!) এসব মাজারে শুধু মুসলমানগণ যায় তা নয় অন্যান্য ধর্মের মানুষও ভক্তি প্রদর্শনাতে মাজারে গিয়ে থাকেন। সুফী দরবেশগণ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের উপকার করতেন, সকলের কল্যাণ কামনা করতেন বিধায় অন্যান্য ধর্মের মানুষও ভক্তি সহকারে সুফি দরবেশগনের মাজারে গিয়ে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে থাকে। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
অনেক মাজারের পরিচালনা সুবিধাভোগী মানুষের হাতে
বর্তমান সময়ে মাজার কেন্দ্রিক অসাধু সুবিধাভোগী,, ভন্ডদের সংখ্যাও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে! অনেক মাজারে ধর্মের নামে, উরছের নামে অসামাজিক, শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপও বৃদ্ধি পেয়েছে! এর কারণ অনেক মাজারের পরিচালনা সুবিধাভোগী মানুষের হাতে চলে এসেছে। তাদের শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপের দরুন মাজারে শুয়ে থাকা অলি আল্লাহগনেরও অপমান করা হয়। এসব কারণে একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে মাজার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাও সৃষ্টি হয়েছে।
মাজার আক্রমণ সঠিক সমাধান নয়
একশ্রেণীর উগ্রপন্থীরা এ সুযোগে মাজার আক্রমণ চালিয়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করছে! মাজার আক্রমণ কিন্তু সঠিক সমাধান নয়। বরং মাজার সমূহকে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ থেকে মুক্ত করে প্রকৃত সুফি দরবেশগণের আদর্শ মানুষের মাঝে প্রচার করলে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সমাজে। আল্লাহর আউলিয়া গণের মাজারে হামলা হলে আল্লাহর গজব নেমে আসতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। কাজেই এ ধরনের কাজে বাধা প্রদান করে ইসলামের সঠিক আদর্শ মানুষের মধ্যে প্রচার করা প্রয়োজন।
মাজার সমূহ মুসলিম ঐতিহ্যের বাহক
বিশেষত এই উপমহাদেশে মাজার, দরগাহ ও দরবার শরীফ সমূহ মুসলিম ঐতিহ্যের বাহক। প্রকৃত সুফি আউলিয়াগনের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। মাজার সমূহ থেকে শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করে ইসলামের সঠিক ঐতিহ্য তুলে ধরা জরুরি।
আরও পড়ুন : ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদযাপন: কোরআন কী বলে?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (দর্শন), বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)
(বর্তমানে দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় কর্মরত)
মতামতের জন্য সম্পাদক/প্রকাশক দায়ি নন। লেখকের একান্ত নিজস্ব।