বিএনএ, ঢাকা: রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৬ জন প্রার্থীকে রাজধানীর পল্টনের একটি পানির ফিল্টারের গুদামে রাখা হয়েছিল। ২০০২ সালের ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করেছে এই চক্রটি। এর পাশাপাশি পিএসসির অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নন ক্যাডার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করেছে।
৯ জুলাই ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আবেদ আলীসহ সাতজনের জবানবন্দিতে এমনই তথ্য বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে এই ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রশ্ন ফাঁস কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া সৈয়দ আবেদ আলী ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ও উত্তর সরবরাহ কাজে জড়িত ছিলেন। পিএসসির নন-ক্যাডার গোপনীয় শাখার তৎকালীন সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে পরীক্ষার্থী আবদুর রহমানসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, ওই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বাহির থেকে উত্তরপত্র লিখিয়ে আনার ঘটনায় জড়িত রয়েছেন আবেদ আলী। ওই মামলার পর চাকুরি হারান আবেদ আলী। আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবারও ‘প্রশ্ন ফাঁস ব্যবসা’ চালিয়ে যান।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পাবলিক পরীক্ষা আইনে করা মামলায় ২০১৪ সালে সৈয়দ আবেদ আলীসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশ। ২০১৫ সালে আবেদ আলীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ৯ বছরে এ মামলার ১২ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র দুজনের সাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছে।
শেরে বাংলা থানা পুলিশের দায়ের করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, সাড়ে ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে আবদুর রহমান নামের এক পরীক্ষার্থীকে চাকরি দেওয়ার কথা পাকাপাকি করেন সৈয়দ আবেদ আলী।
আবেদ আলী পিএসসির তৎকালীন সাঁটমুদ্রাক্ষরিক তারিকুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের সদ্য পাস করা শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার, নন-ক্যাডারসহ যাবতীয় পরীক্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিএসএসির অসাধু কর্মচারীদের সহায়তায় তা বাহিরে নিয়ে আসেন। পরে মেধাবী ছাত্রদের দিয়ে উত্তরপত্র পূরণ করে সেটি পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠানো হয়।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, পিএসসি দেশ ও জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি জীবনের শুরু থেকে দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে থাকার সুবাদে অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এই সিন্ডিকেটের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে যোগদানের আগে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা ছিল; তাঁরা আজ সরকারি অনুমোদনক্রমে জমি, ফ্ল্যাটের ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি, অর্থ-সম্পদের মালিক বনে গেছেন। সৈয়দ আবেদ আলী সামান্য একজন কর্মচারী হলেও প্রতিবছর দেশের বাহিরে ভ্রমণের অনুমতির ছুটিও পিএসসি তাঁকে দিয়েছে। যাতে পিএসসির কর্তৃপক্ষের অসতর্কতা বা উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয় বলে পুলিশের দায়ের করা অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেছেন, পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ তাঁর সিন্ডিকেট বিসিএস, নন–ক্যাডারসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত, সেটি ১০ বছর আগেই আদালতকে জানানো হয়েছিল। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অশুভ সিন্ডিকেটে পিএসসির আর যাঁরা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত ছিল। যদি আবেদ আলীকে নজরদারির মধ্যে রাখা হতো, তাহলে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা পরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ পেতেন না।
সৈয়দ আবেদ আলী ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পিএসিতে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় বাবা সৈয়দ আলী এবং স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের শ্রীফলতলা গ্রামে। প্রকৃত পক্ষে মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত আবদুর রহমান মীরের ছেলে আবেদ আলী। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবদুর রহমান মীরের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আবেদ আলী মেঝ। তাঁর এক ভাই কৃষিকাজ করেন। আরেক ভাই অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে এলাকার মানুষের কাছে আবেদ আলী পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে। তার সম্পদের পরিরমাণ অন্তত ৫০ কোটি টাকা।
দুই বছর আগে থেকে আবেদ আলী তাঁর নিজ এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। তিনি চেয়েছিলেন নতুন উপজেলা ডাসারের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে। এই নির্বাচনের তফসিল এখনো হয়নি। তবে তিনি প্রার্থী হতে দীর্ঘদিন থেকে প্রচার চালাচ্ছেন। এলাকায় তিনি দামি গাড়িতে চড়ে গণসংযোগ করেন।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তিনি পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানদের প্রসঙ্গ তোলেন এবং তাঁরা দায় এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেন।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সৈয়দ আবেদ আলী তাঁর গাড়িচালক ছিলেন না। তিনি পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের আগেই আবেদ আলী চাকরিচ্যুত হন।
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/এইচমুন্নী