স্বাস্থ্য ডেস্ক: দেশে এখন বর্ষা মৌসুম চলছে। প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে হচ্ছে এডিস মশার বংশবিস্তার। এক রত্তি মশার কামড়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। ডেঙ্গু জ্বরে এডিস মশা দায়ী । দেশে প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরের রোগী। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব। হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেকে বাসা-বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ—জ্বর। ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। জ্বর টানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও আসতে পারে। এর সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা যায়।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
জ্বর আসলে, তা ডেঙ্গু জ্বর কিনা তা বুঝতে কিছু উপসর্গের দিকে নজর দিতে হবে। যেমন- শরীরে শীতলতা অনুভব করা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, নিচের পিঠে ব্যথা, পেশি ব্যথা, হাড়ের সংযোগস্থানে ব্যথা, ফুসকুড়ি, ক্লান্তি, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ত্বক-চোখ লাল হওয়া।
ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হওয়ার প্রথম কিছু ঘণ্টায় পায়ে ও হাড়ের সংযোগস্থানে ব্যথা অনুভব হয়ে থাকে। জ্বর খুব দ্রুত বেড়ে গিয়ে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে পারে। এসময় হৃদস্পন্দন হার ও রক্তচাপ কম থাকে। মুখমণ্ডলে লাল অথবা গোলাপী র্যাশ ওঠে, যা পরে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঘাড় ও কুঁচকির লসিকাগ্রন্থি প্রায়সময় ফুলে থাকে।
ডেঙ্গুর ঘরোয়া চিকিৎসা
১. বিশ্রাম নিন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন অথবা তরল জাতীয় খাবার খান। শরীর হাইড্রেটেড থাকলে মাথাব্যথা ও পেশি ব্যথা কম হবে।
২. প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়াতে পেঁপে পাতার রস পান করুন, কারণ ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়। পেঁপে পাতার রস সংক্রমণ তাড়ানোর ক্ষমতাও বাড়াতে পারে।
৩. পেয়ারার শরবত পান করুন। এই পানীয়ের ভিটামিন সি রোগদমনতন্ত্রকে শক্তিশালী করে ডেঙ্গু সংক্রমণ উপশম করবে।
৪. এক মগ গরম পানিতে মেথি বীজ ভিজিয়ে পানীয়টি ঠান্ডা করে পান করুন। এতে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ন্ত্রণে থাকবে ও রোগ উপশমের ক্ষমতা বাড়বে।
৫. রোগের বিরুদ্ধে ভালো লড়াই করে এমন খাবার বেশি করে খান, যেমন- সাইট্রাস ফল, কাঠবাদাম, দই, সূর্যমুখী বীজ, গ্রিন টি, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি, পালংশাক, আদা, রসুন ও হলুদ।শক্তিশালী রোগদমনতন্ত্রের কাছে সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণ সহজেই পরাস্ত হয়।
৬. রক্তের প্লাটিলেট বাড়াতে নিম পাতার রসও পান করতে পারেন। এটি শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যাও বৃদ্ধি করে। নিম পাতার রোগদমন ক্ষমতা বর্ধক শক্তিও আছে।
৭. তুলসি পাতাকে গোল মরিচের সঙ্গে পানিতে সিদ্ধ করে পানীয়টিকে ঠান্ডা করে পান করতে পারেন। এটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে ভালো লড়াই করতে পারে। তুলসি পাতা চাবালেও রোগদমনতন্ত্র শক্তিশালী হবে।
৮. ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পুদিনা পাতার রসও বেশ কার্যকর। এটি সংক্রমণের জ্বর কমাতে পারে, রোগদমনতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে এবং প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়াতে পারে।
কখন হাসপাতালে যেতে হয়?
ডেঙ্গু হলে কী ধরনের চিকিৎসা নেবেন, বাসায় না হাসপাতালে থাকবেন—নির্ভর করে এর ধরন বা ক্যাটাগরির ওপর। ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ধরন বা ক্যাটাগরি আছে—‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’। প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়াই যথেষ্ট।
যে বিষয় এড়িয়ে যাবেন না
ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট এখন আর মূল বিষয় নয়। প্লাটিলেট হিসাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে বা শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজন বোধে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই কম দেখা যায়।
অনেকে বলেন, পেঁপেপাতার জুস ইত্যাদি খেলে প্লাটিলেট বাড়ে। আসলে এসবের কোনো ভূমিকা নেই। জ্বর কমে যাওয়ার পর সংকটকাল পেরিয়ে গেলে আপনা থেকেই প্লাটিলেট বাড়তে শুরু করে।
জ্বরের শেষের দিকে রক্তচাপ কমে যেতে পারে অথবা মাড়ি, নাক, মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। এ রকম হলে প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া লাগতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তাই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে ১০৩৬ জন এবং জুন মাসে ৫৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। আর মৃত্যু হয় জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে দুজন এবং জুন মাসে ৩৪ জনের। গত বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৬২ হাজার ৩৮২ জন । আর মৃত্যু হয় ২৮১ জনের-দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এটাই সর্বোচ্চ। তবে ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাবের পর সবচেয়ে বেশি রোগী হাপসাতালে ভর্তি হয় ২০১৯ সালে-যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। আর সে বছরে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
শুধু বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দেশগুলোতেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।
বিএনএনিউজ২৪/ এমএইচ