।। ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী ।।
তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে ভোগের সামগ্রী বাড়ছে, ভোগের ক্ষুধা অনেক কিছু গ্রাস করছে। ভোগের সামগ্রীর জন্য প্রচুর টাকা দরকার হয়, কারণ ভোগের চাহিদার শেষ নেই। উপভোগে আছে জীবনের সৌন্দর্য ও আনন্দ। নির্মল আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করার ক্ষমতা নতুন প্রজন্মের কমছে। ভোগের সামগ্রী জোগাতে প্রজন্ম অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সব পশুর দৃষ্টি থাকে খাবারের দিকে। চিল আকাশে থাকে কিন্তু আকাশ দেখে না, দৃষ্টি থাকে নিচের দিকে, খাবারের খোঁজে’। পশুদের সব শ্রম ভোগে ব্যয় করে। পশুদের সাহিত্য সংস্কৃতি নেই, মুক্ত আকাশ, মুক্ত সমুদ্র, দৃশ্য উপভোগের ক্ষমতা নেই। পশুদের কাম (যৌনতা) আছে, প্রেম নেই, মানুষের আছে কাম আর প্রেমের মেলবন্ধন। প্রেমহীন কাম পশুত্ব। প্রেমহীন কাম ভোগ, আর প্রেমযুক্ত কাম উপভোগ। এখন ভোগের উৎসবে উপভোগ হারিয়ে যাচ্ছে। পশুর মত মানুষ ভোগের উৎসবে মিলিত হচ্ছে।
আমাদের ছেলেবেলায় একটি লাটিম, একটি ঘুড়ি, একটি খেলনার গাড়ি ছাড়া বেশী কিছু চাওয়ার ছিল না। আজকের সন্তানরা মোটর সাইকেল, কম্পিউটার, নতুন আইফোন, সেরা ব্র্যান্ডের জামা কাপড়, জুতা, নতুন অজানা অনেক পণ্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। আমাদের প্রয়োজন সীমিত কিন্তু চাহিদা অসীম। অবিরত নতুন নতুন পণ্যের হাতছানির যুগে একটা কিছুতে প্রজন্মের তৃপ্তি আসে না। অনেক কিছু পেতে চায়। সেরাটা অন্যের হাতে থাকবে আর আমার কাছে থাকবে না কেন এই চিন্তায় হতাশা কাজ করে। সেরাটার জন্য যে কোন অপরাধে অনেকে যুক্ত হয়ে পড়ছে। বৈধ আয়ে বিলাসী পণ্যের চাহিদা মেটানো যায় না, চোখ ধাধানো বিজ্ঞাপন, দোকানে সাজানো বিলাসী সামগ্রী বিরহ জন্ম দেয়। এত সব ভোগের সামগ্রীর জন্য স্ত্রী-পুত্রের দাবি উপেক্ষা করে দুর্নীতি ত্যাগ করা কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ একবার দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন। মানুষের এমন আজব চরিত্র, যে ভালো মানুষটি জীবনে প্রথম দিন দুর্নীতি করে, তার অপরাধবোধে রাতে ঘুম আসে না। সেই মানুষটিই আস্তে আস্তে দুর্নীতির অন্ধগলিতে হারিয়ে যাওয়ার পর যেদিন দুর্নীতি করতে পারে না সে দিন তার ঘুম আসে না। মানুষের এত পরিবর্তন। হজ্ব, নামাজ কালাম করলেও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত মানুষ দুর্নীতি হতে ফিরে আসতে কমই পারে। ধর্মকেও মুসলমানগণ ভোগের বিষয়ে পরিণত করছে। ধর্মে ভোগ আছে, ভোগ মুখ্য নয়। ভোগ তুচ্ছ, আল্লাহর সন্তুষ্টি উচ্চ। আমরা তুচ্ছকে উচ্চ করছি। উচ্চকে তুচ্ছ করছি। মৌলভীদের ওয়াজের চেয়ে আওয়াজ বেশি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেয়ে তাদের ওয়াজে জাহান্নামের ভয়, আর জান্নাতের লোভের বয়ান বেশী।
হযরত রাবেয়া বসরী (রহ.) এক হাতে পানি আর এক হাতে আগুন নিয়ে একদিন দৌড়াচ্ছিলেন। হাসান বসরী তাঁর নিকট জানতে চাইলেন, কোথায় যাচ্ছেন? রাবেয়া বসরী (রহ.) বললেন, মানুষ জাহান্নামের ভয়ে আর জান্নাতের লোভে ইবাদত করতে করতে জাহান্নাম-জান্নাতের মালিকের সন্তুষ্টি অর্জনের কথা ভুলে গেছে। জাহান্নামের ভয়ে যারা ইবাদত করে আমি তাদের জাহান্নামে পানি ঢেলে দিবো, আর যারা জান্নাতের লোভে ইবাদত করে আমি তাদের জান্নাত আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিব। অথচ জান্নাত জাহান্নামের মালিককে সন্তুষ্ট করতে পারলে জান্নাত আপনাকেই খুঁজবে।
গজনীর বাদশাহ সুলতান মাহমুদ এক কুৎসিত বান্দীকে বেশী পছন্দ করতেন। সব বান্দী একদিন বাদশাহর নিকট জানতে চাইলেন, এত বান্দী, দাসী থাকতে আপনি কালো বান্দীটাকে কেন বেশী পছন্দ করেন? বাদশাহ বললেন, তার উত্তর আগামীকাল দিবো। সবাই ফিরে গেল। বাদশাহ রাজ দরবারের একটি রুমে সোনা, রূপা, ডায়মন্ড, টাকা পৃথক পৃথক ভাবে রাখলেন, পরের দিন সব বান্দী দাসীদের এই রুমে ডেকে বাদশাহ ঘোষণা করলেন, এই রুমের সম্পদ যে যেটা স্পর্শ করবে সেটা তার হয়ে যাবে। সব বান্দী দাসীরা এক এক জন এক এক সম্পদ স্পর্শ করলো, আর কালো বান্দীটি বাদশাহর হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। বাদশাহ জানতে চাইলেন, তুমি কী কোন সম্পদের মালিক হতে চাও না? কুৎসিত বান্দী বললো, জাঁহাপনা! আপনি জীবনে কোন দিন মিথ্যা কথা বলেননি, আজও মিথ্যা বলবেন তা মানে হয় না। আপনি ঘোষণা করছেন, এই রুমে যে যেটা স্পর্শ করবে সেটা তার হয়ে যাবে। আমি রাজা ধরছি, রাজা আমার হলে রাজ্য আমার। আমরা এখন রাজা খুঁজি না, রাজার সামান্য সম্পদ খুঁজি। মহাবিশ্বের মালিক, পরকালের অধিপতি, জান্নাত-জাহান্নামের মালিক মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে সৃষ্টির সেরা হয় আদম সন্তান। আর না হলে হয় পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট জাহান্নামের জ্বালানী।
লোভ আর লাভের দুনিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কফিল উদ্দিনকে কয়েক বছর আগে একটি ল্যাপটপের জন্য বন্ধুরা হত্যা করে। বন্ধুত্ব ও জীবনের চেয়ে একটি ল্যাপটপের দাম অনেক বেশী। মানুষের সম্পর্ক, ভালোবাসা, মায়া মমতার চেয়ে পণ্যাসক্তি অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের কারণ ছিল ক্ষুধার জ্বালা আর প্যারিস, লন্ডনে কিছুদিন পূর্বে দাঙ্গা হয়েছিল কিনতে না পারার জ্বালা। যান্ত্রিক যুগে অভাব আর ক্ষুধার জ্বালার চেয়ে না পাওয়ার যন্ত্রণা অনেক বড়। শিক্ষা এখন পণ্য। Education for earning নয়, Education for Learning হওয়া চাই। ভালো ফলাফল করলে ভালো ছাত্র হবে তা কিন্তু নয়, অনেক মেধাবী ছাত্র পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়ার পর জীবনে অনেক উন্নতি করছে কিন্তু তার পিতা-মাতা অসহায় জীবন যাপন করছে। ছেলে তাদের খবর রাখে না। এক পিতা তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ করে ছেলেকে ডাক্তারী পড়ান, সে ছেলে বৃদ্ধা মা-বাবার খবর রাখে না। এই ধরণের কুলাঙ্গার সন্তানদের নিকট তার কারণ জানতে চাইলে, সে বলে তার সময় নেই। তাদের সময় নেই তা ঠিক নয়, প্রকৃত পক্ষে এ ধরনের কথা যারা বলে, তাদের নিকট মায়া নেই, মমতা নেই, মূল্যবোধ নেই, মানবিকতা নেই, তার নিকট মনুষ্যত্ব নেই, অনেক কিছু নেই, অর্থ ও স্বার্থের লোভে তারা অন্ধ। সমাজে ভালো মানুষের প্রয়োজন, বড় লোক দরকার নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের দেশে যার অঢেল টাকা সে বড় লোক, মনুষ্যত্ব বিষয় আশয়ে নয়’। তিনি আরো বলেছেন, ‘মনুষ্যত্বে শিক্ষাই বড়, সমস্ত শিক্ষাই তার অধীন’।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জ্ঞান ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করে। অর্থাৎ যে জ্ঞান ন্যায় অন্যায়কে পৃথক করে না তা জ্ঞান নয়। প্রকৃত জ্ঞান সত্য মিথ্যার পার্থক্য করে। তথ্য নয়, সত্যের জ্ঞান প্রার্থনার চেয়ে উত্তম।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (দ.)একদিন দুটি মজলিশের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, একটি আল্লাহর নিকট প্রার্থনার সভা, অন্যটি দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষার সভা। নবী (দ.) বললেন, যারা মূর্খদের জ্ঞান শিক্ষা দিচ্ছেন তারা উত্তম। একথা বলার সাথে সাথে তিনি জ্ঞানের মজলিশে বসে পড়েন এবং বলেন, ‘আমি জগতে শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। আগুনের ধর্ম জ্বালানো, পানির ধর্ম নীচের দিকে গড়িয়ে পড়া, বাঘের ধর্ম হিংস্রতা, মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব। কিন্তু মানুষ মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে না, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। আমাদের কী নেই? সবকিছু আছে। এই থাকাটাকে সুন্দর করতে প্রয়োজন একদল আদর্শ মানুষ তৈরী করা। এই কাজে এখনো আমরা অনেক দূর পিছিয়ে।
যান্ত্রিক যুগে হৃদয়ের আকুতি শোনার লোক কমছে। মানুষ যেন স্বার্থপর মেশিন। বক্সে কয়েন ফেলে কপি খাওয়ার মত অবস্থা। ভালোবাসা যেন লোগোযুক্ত। ভালোবাসা গল্প উপন্যাসের মত নয়, ভালোবাসা এখন রূপ বদলায়, রং বদলায়, একের পর মানুষ বদলায়। ভালোবাসা এখন হিংস্রতা আর শারীরিক ভোগ। ভালোবাসার নামে সবকিছুর শেষে ব্ল্যাক মেইল করে মোবাইল ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয় নানা গোপন ছবি? এসব আমাদের অসুস্থতা, অসুখ মানে সুখের অভাব। সুখ জিনিসটা শরীরের নয়, মনের। হাতের শিকল ভাঙা সহজ, মনের শিকল ভাঙা কঠিন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, হাতের শিকল ভেঙেছি এবার মনের শিকলে পড়ে টান’। কবি আগে মনের শিকল ভেঙে ছিলেন, পরে হাতের শিকল ভেঙেছেন। আমরা আমাদের সমস্ত মনের শিকল ভাঙতে পারলে, মনের সব দীনতা হীনতা হতে মুক্তি পাবো।
লেখক: কলাম লেখক ও রাজনীতিক