বিএনএ : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতেই চলছে ধারাবাহিক আন্দোলন। এতে কার্যত একাডেমিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ, অবরোধ করছেন।
সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩ তম মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার রায় স্থগিত হয়নি। গত ৪ জুলাই রিট আবেদনকারীপক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ‘আজ নয়’ বলে আদেশ দেন। এ সময় পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর কোটা নিয়ে নিয়মিত আপিল করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রাজপথে আন্দোলন করে সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবর্তন করা যায় কিনা— এমন প্রশ্নও তোলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ফলে আপাতত চাকরিতে কোটা বহাল থাকছে।
এদিকে এ খবর আসার পর থেকে ক্ষোভে ফুঁসছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শুরু হয়েছে আন্দোলন; বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সড়ক-মহাসড়ক-রেলপথ অবরোধ করে চলছে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি। দেওয়া হয়েছে বাংলা ব্লকেড নামের কর্মসূচি—যাতে করে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। ঢাকার বাইরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রংপুরসহ একাধিক জায়গায় চলছে শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচি।
শিক্ষার্থীদের লাগাতার এ আন্দোলনে বাঁধা দিচ্ছে না পুলিশ। ছাত্রলীগসহ আওয়ামীলীগের সহযোগী দলগুলোও বেশ নীরব অবস্থানে রয়েছে। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এ আন্দোলন কোন দিকে যাচ্ছে।
জানা গেছে, কোটা আন্দোলন নিয়ে সরকারের মধ্যেও অস্বস্তি বাড়ছে৷ চলমান শিক্ষকদের পেনশন আন্দোলনের চেয়েও, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
এ আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়ে তীব্র হতে পারে এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা ও সমাধানের পথ বের করার উপায় নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
প্রথম দিকে সরকার বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণে রেখেছিল। কিন্তু আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় এবং তা জোরালো হয়ে ওঠায় সরকার সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগও তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে বিএনপি সমর্থন দেওয়ায় বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি ঘোষণা দিয়েও সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন দাঁড় করাতে পারেনি। কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উসকানি ও জনমনে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করতে পারে বিএনপি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টাও হতে পারে এমন ধারণাও করা হচ্ছে। আন্দোলনে বিএনপির সমর্থনের মধ্য দিয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের এ আশঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে বলে জানা গেছে।
সোমবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে পক্ষ নিতে পারে না। বিএনপি প্রকাশ্যে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে, তাই নতুন করে বলার কিছু নেই।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটা বাতিল মীমাংসিত ইস্যু। নতুন করে কোটা ফিরিয়ে আনা ছাত্র সমাজের সঙ্গে তামাশা। কোনোভাবেই বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি মেনে নেয়া হবে না।
কোটা প্রসঙ্গে কিছুটা কৌশলী অবস্থানেও রয়েছে সরকার। গণমাধ্যমে মন্ত্রী এবং সরকার দলের নেতারা স্পর্শকাতর এ বিষয়ে কথা বলার ব্যাপারেও বেশ সতর্ক। এমন সময়ে এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৭ ই জুলাই যুব মহিলা লীগের প্রতিষ্ঠা বির্ষিকী উপলক্ষ্যে গণভবনে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। পড়াশোনা বাদ দিয়ে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণ দেখি না। এই আন্দোলনে পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা আরো বলেন, সরকার কোটা বাতিল করলেও এতে লাভ হয়নি। বরং অনেক মেয়ে চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে আরও বলেন, কোটা বাতিলের কারণে অনেক জেলার মানুষ বঞ্চিত হয়েছে। এমন একজনের মামলায় কোটার পক্ষে রায় দিয়েছে আদালত। সেই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি সংশোধন করে পরিপত্র জারি করে।
১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চের স্মারক সংশোধন করে জারি করা পরিপত্রের ভাষ্য, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) ও ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) ও ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি বাতিল করা হলো।
পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে ওই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট।
শিক্ষার্থীরা বলছেন প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় কোটা রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ২০১৮ সালে সরকার যে ইস্যুটিকে সমাধান করেছে, সেটিকে ৬ বছর পর কেন আলোচনায় নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে—প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের।
বিএনএ/ সৈয়দ সাকিব/এইচ.এম/এইচমুন্নী