।। মনির ফয়সাল ।।
অবশেষে করোনাভাইরাসের ভারতীয় (ধরন) শনাক্ত হয়েছে। ভারতীয় ধরনটি ‘বি.১.১৬৭’নামে পরিচিত এ ধরনটি অতি সংক্রামক। ভারতে করোনা ব্যাপক প্রাণহানির পর বাংলাদেশে এ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাজ পড়েছে।
ভারতের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তার মধ্যে একটি হলো করোনার অতি সংক্রামক ধরনের বিস্তার। করোনাভাইরাসের জিনোমের উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে করোনার এ ধরন শনাক্তের খবর প্রকাশিত হয়েছে।
জিআইএসএআইডির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই দুই ব্যক্তির একজনের বয়স ৪১ বছর। বাংলাদেশে তাঁর বাসা ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে। এই ব্যক্তি ভারতে ভ্রমণের সময় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি করোনাভাইরাসের কোনো টিকা নেননি। এই ব্যক্তির কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইদেশি)।
ভারতীয় করোনার ধরন শনাক্ত হওয়া দ্বিতীয়জনের বয়স ২৩ বছর। তাঁর বাসা খুলনায়। এই ব্যক্তিও ভারতে ভ্রমণের সময় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি।
জিআইএসএআইডির তথ্য বলছে, এই দুই ব্যক্তির বর্তমান অবস্থা ও তাঁরা কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
জানা গেছে, ঝিনাইদহে ভারত থেকে আসা ১৪৭ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে পৃথক দুইটি কোয়ারেন্টিন সেন্টারে রাখা হয়েছে। এছাড়াও সদর হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে দুইজনকে। তবে তারা কেউ করোনা রোগী নন। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্রে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।
ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম জানান, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে যারা আসছেন তাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তিদের যশোর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অন্যদের ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিন সেন্টারে রাখা হচ্ছে। তিনি জানান, স্থান সংকুলান না হওয়ায় যশোর থেকে বেশকিছু ভারত ফেরত নারী-পুরুষ শিশুদের ঝিনাইদহের দুইটি কোয়ারেন্টিন সেন্টারে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজন রোগীকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা চলমান রাখা হয়েছে। কারণ তারা চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছিলেন। কতজনকে কোয়ারেন্টিন সেন্টারে রাখা হয়েছে তার সঠিক হিসাব জানা নেই বলে জানান স্বাস্থ্য বিভাগের এই কর্মকর্তা।
সাতক্ষীরা শহরের আবাসিক হোটেল রজনী, হাসান, উত্তরা, টাইগার প্লাস, কাশেম ও আরও তিন হোটেলে রয়েছেন ভারত থেকে ফেরা ২৫০ জন বাংলাদেশি। তারা সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। গত বুধবার (৫ মে) থেকে আজ (শুক্রবার, ৭ মে) সকাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে তাদের কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানা যায়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে ব্যাপক হারে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় গত ২৬ এপ্রিল থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে ভারতে আটকা পড়েন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী। তাদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপ-হাইকমিশন থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরতে হচ্ছে। দেশে ফেরার পর তাদের থাকতে হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে। প্রথমে বেনাপোলে রাখা হলেও পরে যশোরের ২৯টি হোটেলে এই কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, গত ২৬ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত বেনাপোল দিয়ে দেশে ফিরেছেন দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ। যশোর ও বেনাপোলের ২৯টি হোটেল ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য পাঠানো হচ্ছে এই পাসপোর্টযাত্রীদের।
গত ৬ মে খুলনার ফুলতলার ১টি আবাসিক হোটেলে ভারত ফেরত ৫১ বাংলাদেশিকে প্রশাসনের নির্দেশনায় ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। খুলনা জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়নে ও থানা পুলিশের বিশেষ সহায়তায় রাতে তাদেরকে ঐ হোটেলে হোম কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়।
এ বিষয়ে ইউএনও সাদিয়া আফরিন জানান, ভারতে চিকিৎসা শেষে দেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা বিভিন্ন বয়সী নারী, পুরুষ ও শিশুরা সীমান্ত এলাকায় কোভিড-১৯ এর টেস্টে নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়েই দেশে ফিরেছে। ফলে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত ঝুকির কোন আশংকা নেই। তবে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়।
এদিকে ভারত ফেরত করোনায় আক্রান্ত এক শিশুকে তার বাবা ও মাসহ রাজধানীর পল্টনের একটি আবাসিক হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। শিশুটির বয়স এক বছর নয় মাস। শিশুটির বাবা-মার বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। ৫ মে ভোর রাতে শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নিয়ে যান। তবে হাসপাতালের নতুন ভবনের করোনা বিভাগে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারাইন্টানে রাখার কোন সুযোগ না থাকায় তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়। এসময় হাসপাতালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওয়ার্ডে রাখার ঝুঁকি না নিয়ে তাকে রাজধানীর পল্টন এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে কোয়ারাইন্টেনে রয়েছে শিশু ও তার পরিবারের সদস্যরা।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, সম্প্রতি ওই পরিবারটি চিকিৎসার জন্য ভারতের কলকাতায় গিয়েছিলেন। সেখানে শিশুটি করোনায় আক্রান্ত হন। তবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা চিকিৎসা শেষে ৪ মে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। শিশুটির করোনার উপসর্গ দেখে সেখান থেকে তাদেরকে সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
শুধু খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নয়; চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়েছে ভারত ফেরত ১০ জনকে। তবে এ ১০ জনের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস পাওয়া যায়নি। তাদের যশোর বক্ষ্যব্যাধি হাসপাতাল থেকে শুক্রবার (৭ মে) ভোর রাত ৩টার দিকে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। বতর্মানে তাদেরকে হাসপাতালের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, ভারত ফেরত এই ১০ জনের মধ্যে সাতজনকে হাসপাতালের ২৯নং ওয়ার্ডের কেবিনে ও তিনজনকে ১৬নং মেডিসিন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ক্যানসার আক্রান্ত রোগী। রয়েছেন তাদের অভিভাবকও। তাদের মধ্যে ফটিকছড়ি উপজেলার তিনজন, চন্দনাইশ উপজেলার তিনজন, কর্ণফুলী থানার তিন এবং পটিয়া উপজেলার একজন রয়েছেন।
২৯ নম্বর ওয়ার্ডে কোয়ারেন্টাইনে ভর্তি হওয়া রোগীরা হলেন- চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা ফজল করিমের ছেলে রেজাউল করিম রাজু (২৪), চন্দনাইশের বাসিন্দা ইউসুফের মেয়ে হাসমত আরা বেগম (৫২), একই উপজেলার বাসিন্দা ফজল কাদেরের মেয়ে আয়শা সুলতানা (২৪), ফটিকছড়ির বাসিন্দা ইউসুফের ছেলে ইকবাল হোসেন (২৪), একই উপজেলার বাসিন্দা জহুরের ছেলে রমজান আলী (২১), কর্ণফুলী থানার বাসিন্দা মৃত রশিদ আলীর ছেলে আনিছুর রহমান ও একই উপজেলার বাসিন্দা ইকবাল আহমেদের মেয়ে ফাহমিদা ইয়াসমিন (১৯)।
অপরদিকে অসুস্থ হয়ে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তিকৃত রোগীরা হলেন- চট্টগ্রামের চন্দানাইশ উপজেলার বাসিন্দা ইলিয়াছের ছেলে জাকারিয়া (৩৪), ফটিকছড়ি উপজেলার বাসিন্দা ইউসুফের মেয়ে রহিমা বেগম (৪৬) ও কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা ইকবাল আহমেদের স্ত্রী পারভিন আক্তার (৪১)।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ভারত ফেরত এদের কারও শরীরে কোভিড শনাক্ত হয়নি। তিন জনের শরীর অসুস্থ থাকায় তাদের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি দেয়া হয়েছে। সবাইকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ইউনিভার্সিটি (সিভাসু) উপাচার্যের নেতৃত্বে একদল শিক্ষক চট্টগ্রামের করোনার ধরন নিয়ে পরীক্ষা করেন। এসব পরীক্ষায় যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের করোনার ধরন মিলছে। কিন্তু ভারতীয় কোনো ধরন নমুনা পরীক্ষায় পাওয়া যায় নি। এ নিয়ে চট্টগ্রামবাসী একটু স্বস্তিও পেয়েছিল। তবে এবার ভারতীয় ধরন ছড়ানোর ভয় চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে কাজ করছে।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ইউনিভার্সিটির (সিভাসু) গবেষকরা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট বা বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস এখন চট্টগ্রামে ঘুরছে। সীমিত আকারে মিলেছে অস্ট্রেলিয়া-আইসল্যান্ড-সুইজারল্যান্ড অঞ্চলভিত্তিক করোনার ধরনও।
নতুন বৈশিষ্ট্যের করোনার উপস্থিতি পাওয়া গেছে যাদের শরীরে, তারা চট্টগ্রামের মেহেদিবাগ, জামালখান, রহমতগঞ্জ, শুলকবহর, মুরাদপুর, কাজির দেউড়ি, বন্দর, কুঞ্জছায়া আবাসিক এলাকা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রী হোস্টেলের বাসিন্দা।
গবেষণায় করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্য ভ্যারিয়েন্টের (B.1.1.7) উপস্থিতি পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের মেহেদিবাগের ৩২ বছর বয়সী এক পুরুষ, জামালখান এলাকার ৬৪ বছর বয়সী এক পুরুষ, রহমতগঞ্জ এলাকার ৬৩ বছর বয়সী এক পুরুষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রী হোস্টেলের ২৪ বছর বয়সী এক তরুণী, শুলকবহর এলাকার ৩২ বছর বয়সী এক পুরুষ এবং মুরাদপুরের ৬০ বছর বয়সী এক পুরুষের শরীরে।
অন্যদিকে আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের (B.1.351) উপস্থিতি মিলেছে জামালখান এলাকার ২২ বছর বয়সী এক তরুণ, বন্দর এলাকার ৬৫ বছর বয়সী এক পুরুষ এবং কাজির দেউড়ি এলাকার ৩২ বছর বয়সী এক পুরুষের মধ্যে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া-আইসল্যান্ড-সুইজারল্যান্ড অঞ্চলভিত্তিক করোনার ধরনে মিল পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের কুঞ্জছায়া আবাসিক এলাকার ৩১ বছর বয়সী এক পুরুষের শরীরে।
এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ধরনের অস্তিত্ব মেলে বাংলাদেশে। ঢাকার বনানীর ৫৮ বছর বয়সী এক নারীর শরীর থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় এই স্ট্রেইন পাওয়া যায় বলে নিশ্চিত করে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষক দল।
এছাড়া গত ৫ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসা ছয়জনের দেহে করোনাভাইরাসের আরেক নতুন ধরন পাওয়া যায় বলে আইইডিসিআর থেকে জানানো হয়। রূপান্তরিত এই নতুন ধরন গত ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। এরপর ধীরে ধীরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১১ হাজার ৮৭৮ জন এবং শনাক্ত হয়েছে ৭ লাখ ৭২ হাজার ১২৭ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ৪৫ জন। একই সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও এক হাজার ২৮৫ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
বিএনএনিউজ/ওয়াই এইচ