বিএনএ,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর অভয়মিত্র ঘাটের ইজারা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পেশাদার সাম্পান মাঝিরা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। একাধিক আদালতের আদেশ সত্ত্বেও মাঝিরা অভিযোগ তুলছেন, তাঁদের অধিকার উপেক্ষা করে বহিরাগত ব্যবসায়ীদের হাতে ঘাট তুলে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে বলে মাঝিদের অভিযোগ।
এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে কর্ণফুলীর ২১৪ জন পাটনিজীবী মাঝির পক্ষ থেকে ৪ হাজার ৫০০ মানুষের স্বার্থ বিবেচনায় চরপাথরঘাটা ব্রিজঘাট সাম্পান চালক কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন। এতে অভয়মিত্র ঘাটের ইজারা পুনরুদ্ধারের দাবি জানানো হয়।
সাম্পান মাঝিদের অভিযোগ, প্রকৃত পাটনিজীবীদের থেকে ঘাট কেড়ে নিয়ে নীতিমালা লঙ্ঘন করে কিছু ব্যবসায়ী ইজারা পেতে চক্রান্ত করছেন। কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এস এম পেয়ার আলী বলেন, ‘২০০৩ সালের পাটনিজীবী নীতিমালা তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে মাঝিদের ঘাট ছাড়া করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা চাই, চসিক মাঝিদের অধিকার রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিক।’
আদালতের একাধিক আদেশ: তবুও সংকট কাটেনি
উল্লেখ্য, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রিট পিটিশন ১৫১৬৩/২৩ মামলার আদেশ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অভয়মিত্র ঘাটের ইজারা কার্যক্রম স্থগিত রাখে। কিন্তু পরবর্তীতে ২৩ অক্টোবর চসিকের সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ফেরিঘাট ইজারার ১০ নম্বর শর্ত প্রত্যাহার করে একটি চিঠি ইস্যু করেন। এতে বলা হয়, ‘মামলা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায়’ চসিক কর্তৃপক্ষ শর্তটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এর আগে, ২০ অক্টোবর চসিকের এস্টেট শাখার বাজার পরিদর্শককে খাস আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং সাম্পান সরবরাহের জন্য একজন কে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু মাঝিদের প্রতিবাদ ও অনশন কর্মসূচির মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয় চসিক, এবং ঘাটটি ফের পাটনিজীবী মাঝিদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি, ব্রিজঘাট সাম্পান চালক কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও এস্টেট শাখার বরাবর আবেদন করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি বর্তমান ইজারাদার হিসেবে যাত্রী সাধারণের সন্তুষ্টি বজায় রেখে কাজ করছি। মাঝিদের ইজারা না পেলে ৪ হাজার ৫০০ মানুষ অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হবে।’
এরপর, সম্ভাব্য মূল্যে ইজারা দেওয়ার জন্য ১৭ নভেম্বর আরও একটি আবেদন করা হয়, যার উত্তর না পেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন (১৪৪০৪/২৪) দায়ের করা হয়। আদালত ২ মাসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন।
আইন ও নীতিমালার স্পষ্ট নির্দেশনা
হাইকোর্টের আদেশ ছাড়াও সরকারি নীতিমালায় পাটনিজীবীদের অধিকার সুস্পষ্ট। স্থানীয় সরকার নীতিমালার ফেরিঘাট ব্যবস্থাপনা নীতিতে (অনুচ্ছেদ ২) জন্মগত পেশাদার পাটনীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল ১৯৯০-এর ২৪০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ীও পেশাদার মাঝিদের ঘাট ইজারা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
মাঝিদের উদ্বেগ ও সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা
চরপাথরঘাটা ব্রিজঘাট সাম্পান চালক সমিতির সভাপতি মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘চসিক পেশাদার মাঝিদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে বহিরাগতদের ইজারা দিতে চাইছে। এটি যদি হয়, তাহলে কর্ণফুলীর মাঝিরা কর্মহীন হয়ে পড়বে, যা মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।’
কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এস এম পেয়ার আলী বলেন, ‘বৈঠা যার, ঘাট তার— এই দাবি মানতে হবে। বহিরাগতদের দিয়ে ঘাট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।’
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান মাঝিদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে বলেন, ‘যাঁদের পেশা সাম্পান চালানো, তাঁদের সেটি করার অধিকার দেওয়া উচিত। স্বাধীনতার মূল আদর্শই হচ্ছে প্রত্যেককে তাঁর জীবিকা নির্বাহের ন্যায্য সুযোগ দেওয়া।’
এ বিষয়ে কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের উপদেষ্টা আলীউর রহমান বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনকে অবশ্যই হাইকোর্টের আদেশ মানতে হবে। অন্যথায়, আইন অমান্য করার দায়ভার চসিক প্রশাসনকে নিতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (উপসচিব) এস. এম. সরওয়ার কামাল বলেন, ‘সাম্পান মাঝিদের দুঃখ-কষ্ট আমরা গভীরভাবে অনুভব করি। আদালতের মামলা প্রত্যাহারের ফলে এখন আমরা ঘাটগুলো ইজারা দিতে সক্ষম হচ্ছি, যা সিটি কর্পোরেশন ও সরকারের রাজস্ব আয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে আমরা সর্বদা নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকেই মাঝিদের চাহিদা পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। এ বিষয়ে মাঝিদের উচিত মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা, কারণ তিনিই নির্বাহী ক্ষমতার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
পরিস্থিতির সমাধানে করণীয়
বিশ্লেষকদের মতে, চসিক যদি নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করে এবং আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করে, তবে এই সংকট নিরসন সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে প্রকৃত পাটনিজীবী মাঝিদের ইজারা প্রদান নিশ্চিত করলে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
আদালতের একাধিক আদেশ এবং সরকারি নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও অভয়মিত্র ঘাট ইজারাকে কেন্দ্র করে টানাপোড়েন চলছেই। পাটনিজীবী মাঝিরা তাঁদের পেশাগত অধিকার রক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে চসিকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সংকট নিরসনে স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশনকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে কর্ণফুলীর পেশাদার মাঝিরা তাঁদের পেশা রক্ষা করতে পারেন।
বিএনএনিউজ / আরএস
