।। সৈয়দ সাকিব ।।
বিএনএ, চট্টগ্রাম: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার ‘রিমোট কন্টোল’ রাজনীতি নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঠান্ডা লড়াই দীর্ঘদিনের। তারেক জিয়া তার পছন্দের ব্যক্তিদেরকে দলে রাখছেন। অপছন্দের ব্যক্তিদেরকে দল থেকে বের করে দিচ্ছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। গত ১৫ বছর ধরে গঠনতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন তারেক জিয়া। তার এমন স্বেচ্ছাচারিতা দলের ভিতরে এক ধরনের বিস্ফোরণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
তারেক জিয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মনে করেছিলেন, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুচ ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। আর বিএনপি ক্ষমতার পালা বদলের বেনিফিশিয়ারি হবে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দেশের বড় বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপাসন।
ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, পিটার হাস বিএনপি পক্ষে অবস্থান নিয়ে পরোক্ষভাবে সরকারের পক্ষে কাজ করেছে! নির্বাচনের আগে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা এমনটা বিশ্বাস করতে না চাইলেও নির্বাচন পরবর্তীতে তাদের মধ্যে এই উপলব্দি জন্মেছে যে, ভারতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ি কাজ করেছে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
তবে বোমটি ফাটিয়েছে, পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। তিনি ভারতের একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ, যিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ থেকে অবসর নেন কয়েক বছর আগে। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ২০০৭ থেকে ২০০৯ এই পুরো তিন বছর তিনি ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়কালেই বাংলাদেশ দীর্ঘ দু’বছর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনে ছিল। তারপর ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, তারও প্রথম এক বছর তিনি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন।
গত ২৮ মার্চ দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে তার বক্তব্য ছিল বাংলাদেশের নিজস্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমেরিকার অতিরিক্ত ‘হস্তক্ষেপে’র চেষ্টা ভারত যে পছন্দ করছে না এবং তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে– দিল্লি তাদের এই মনোভাবের কথা গত নভেম্বরে ‘টু প্লাস টু ডায়ালগে’র সময়ই ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিল। এর ঠিক দু’মাসের মধ্যেই (৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন “আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ভারতের পক্ষ থেকে তখন এই কড়া বার্তাটা (আমেরিকাকে) শুনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার পরিণতিতে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত, যিনি তার কিছুদিন আগেও অমুক বিএনপি নেতাকে দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে ডেকে আনছিলেন বা তমুক বিএনপি নেতার বাসায় গিয়ে হাজির হচ্ছিলেন– তাকে আর ভোটের সময় দেখাই গেল না! কোথায় যে তিনি গা ঢাকা দিলেন সে কেবল তিনিই জানেন!”
অবশ্য আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সোমবার তাদের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, “এই বক্তব্য সঠিক নয়।”
বিএনপির নেতারা মনে করে, ভারতের কুটচালে তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। পিটার হাসও পিছুটান দেয়। নির্বাচন বানচালের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ছাড় না দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে। যদিও তারেক জিয়ার চাপে তারা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ৭৬ নেতা ভোট করছেন। তাদের সবাইকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জন চেয়ারম্যান, ২৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান এবং সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২১ জন প্রার্থী রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে দল থেকে বহিষ্কৃত, অন্য দলে যোগ দেয়া এবং দলীয় নেতাদের আত্মীয়-স্বজনরাও রয়েছেন।
তবে বহিষ্কৃত নেতারা, দল কী করছে- সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। তারা বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন নির্বাচিত হয়েছিলেন। দল তাকে আদেশ করেছিল দায়িত্ব গ্রহণ না করার জন্য। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির পদটি গ্রহণ করেন। আর তার এই পদ গ্রহণের কারণে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল। কিন্তু এই অব্যাহতি শেষ পর্যন্ত টেকেনি। এখন তাকে দলে রাখার সিদ্ধান্ত যেমন নেওয়া হয়েছে, তেমনই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি পদে থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তারেক জিয়ার এই সিদ্ধান্তে বিএনপির আইনজীবীদের একাংশ যারা মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধে তারা ক্ষুব্ধ হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলীসহ সিনিয়র আইনজীবীরা বলছেন, তারেক জিয়ার নির্দেশেই তারা খোকনের ব্যাপারে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আবার তারেক জিয়াই তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন।
বিএনপির মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে মাহবুব উদ্দিন খোকন যদি নির্বাচন করে এবং জিতে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে তাহলে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীরা কী দোষ করল? বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত হল বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। আর এই ধারাবাহিকতায় বিএনপির বিভিন্ন পেশাজীবীদের নির্বাচনও বর্জন করছে। এর আগে প্রকৌশলী ও ডাক্তারদের নির্বাচনও বর্জন করেছিল।
আর এরকম একটি পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে কেন বিএনপি অংশগ্রহণ করল? সেটি যেমন একটি বড় প্রশ্ন, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে কারো জন্য হ্যাঁ, কারো জন্য না কেন?
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদেরকে বলেছেন, এই সমস্ত কীভাবে হচ্ছে আমি জানি না। আপনাদের যদি কোনও কিছু বলার থাকে আপনারা লন্ডনে যোগাযোগ করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারেক জিয়ার ‘না’ তে বিএনপি নেতাকর্মীরা নেতিয়ে যাচ্ছে।
বিএনএনিউজ/ বিএম