বিএনএ, চট্টগ্রাম : বাংলাদেশের গর্ব ‘পতাকা কন্যা’ খ্যাত প্রথম বিশ্বজয়ী পরিব্রাজক নাজমুন নাহার এর সম্মানে বন্দরনগরীতে অনুষ্ঠিত হবে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বপ্নযাত্রী’র আয়োজনে শুক্রবার (১ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি হলে বিকেল ৪ টায় অনুষ্ঠিত হবে এ আয়োজন। নাজমুনের সম্মানে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, কবি ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম, বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি সাংবাদিক এজাজ ইউসুফী, লক্ষ্মীপুর জেলা সমিতির সভাপতি, সাবেক কাউন্সিলর আলহাজ মো. এম. এ কাশেম, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক নাট্যজন সাইফুলআলম বাবু।
উল্লেখ্য : বিশ্বের ১৪৪ দেশে ভ্রমণকারী এই পরিব্রাজকের এ যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালে ভারত ভ্রমণের মধ্যদিয়ে। এই ২০ বছরে মাকে নিয়ে ১৪ দেশ ঘুরলেও বাকি ১৩০ টি দেশ ঘুরেছেন একাই। যার অধিকাংশই সড়কপথে। যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই বাংলাদেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরে শান্তি এ একতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন নাজমুন। তার লক্ষ্য একে পৃথিবীর সব দেশের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরা।
এক নজরে নাজমুন নাহার : বাংলাদেশের পতাকা হাতে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পৃথিবীর ১৪৪ দেশ ভ্রমণের রেকর্ড সৃষ্টি করেন। সেই আলােকিত মানুষটি আমাদের দেশের জন্য বিরাট গৌরব বয়েএনেছেন। ১৪৪ দেশেই তার ভ্রমণ শেষ নয়, তিনি বাংলাদেশের পতাকাকে পৌঁছে দিবেন পৃথিবীর প্রতিটি দেশে। যিনি ইতিমধ্যেই শিরোনাম হয়েছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় অগ্রগামী নারীর উদাহরণ হিসেবে তার নাম স্থান পেয়েছে, এছাড়া নরওয়ের সিস্টাহুড রিসার্চ ম্যাগাজিনের কভার স্টোরিতে স্থান পেয়েছে মুসলিম বিশ্বের সেরা নারীদের একজন হিসেবে। যার এই কষ্ট এবং অর্জনকে যদিও পুরস্কারের মূল্য মাপা যাবে না তারপরও বলছি- তার প্রাপ্তির ঝুলিতে যােগহয়েছে বহু অ্যাওয়ার্ড, সম্মাননা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পিস টর্চ বিয়ারারঅ্যাওয়ার্ড। যে অ্যাওয়ার্ডটিপেয়েছেন পৃথিবীর অনেক বড় বড় রাষ্ট্রপতি- মিখাইল গর্বাচেভ, নেলসন ম্যান্ডেলাসহ অনেক বিখ্যাত মানুষেরা, প্রথম ‘পিস টর্চ বিয়ারার পুরস্কারটি নয় বারের অলিম্পিক স্বর্ণপদক এবং পিস রানের মুখপাত্র কাল লুইসকে দেওয়াহয়েছিল। বাংলাদেশ তার অর্জনের ঝুলিতে যােগহয়েছে অনন্যা শীর্ষ দশ আওয়ার্ড। এছাড়া ২০১৯ এর নভেম্বরে জন্টা ইন্টারন্যাশনাল তাকে দিয়েছে আরেক বিরাট সম্মাননা-তিনি পেয়েছেন গেমচেঞ্জার অব বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড, অতীশ দীপঙ্করগােল্ডমেডেলঅ্যাওয়ার্ডসহ দেশী ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বেশ কয়েকটিসম্মাননা তিনি পেয়েছেন।
উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন : নাজমুন নাহার উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এবং একজন গবেষক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে তিনি গ্রাজুয়েশন করেছেন। আজকের এই আলোকিত নারী নাজমুন যাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। নিজ দেশের পতাকা হাতে সর্বাধিক রাষ্ট্র ভ্রমণকারী হিসাবে যার নাম আজ বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর ইতিহাসে সংযুক্ত হলো। সাধারণ জ্ঞানের বইয়ের পাতায় যার নাম এখন আমরা পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের যার নাম স্থান পেয়েছে। নাজমুন নাহার সম্প্রতি মালদ্বীপে ১৪৪ তম দেশ ভ্রমণের রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
ভ্রমণ অভিযাত্রা : ২০০০ সালে প্রথম ইন্ডিয়া দিয়ে শুরু হয় তার পৃথিবী ভ্ৰমণ অভিযাত্রা। ২০ বছর তিনি পৃথিবীর পথে পথেঅভিযাত্রা করেছেন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, বাংলাদেশের পতাকাকে বিশ্ব দরবারে সর্বোচ্চ উচ্চতায়নিয়ে যাওয়ার জন্য। সম্পূর্ণ ভ্রমণই ছিল একা একা, শুধু ১৪ টি দেশের ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন তার মা। নাজমুন নাহার পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ ভ্রমণ করেছেন সড়কপথে একটা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দেখার জন্য এবং কম খরচে পৃথিবী ঘোরার জন্য তিনি সড়ক পথে ভ্ৰমণের পন্থা বেছে নিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ম্যাপের উপর রিসার্চ করেছেন কিভাবে কম খরচে ভ্রমণ করা যায়। তিনি শুধু কোন একটা দেশের শহর ঘুরে ফিরে আসেননি, তিনি উঠেছেন পেরুর রেইনবোসামিটেরমতো পৃথিবীর বহু পর্বত সামিটে যেখানে প্রচণ্ড আল্টিচুডের কারণে মৃত্যুমুখেপড়েও আবার বিধাতার ইচ্ছে আবার ফিরে এসেছেন মৃত্যুমুখ থেকে। চিলির আতাকামা যেখানে ১০০ বহুরে বৃষ্টি হয়নি এমন আশ্চর্যজনক জায়গাতেও পা পড়েছেনাজমুননাহারের।
অনেক দ্বীপে রাতের অন্ধকারে হারিয়েছিল নাজমুন : অনেক দ্বীপে রাতের অন্ধকারে তিনি হারিয়ে গেছেন, আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ২৬ ঘণ্টা জঙ্গলে আটকা পড়েছেন রাতের অন্ধকারে। জর্জিয়ারসনেটি প্রদেশ যাওয়ার সময় পথে গুলির মুখোমুখি হয়ে পাহাড়ে বুক বিছিয়ে ৪ ঘণ্টা শুয়ে ছিলেন। সাহারা মরুভূমিতে ভয়ঙ্কর মরুঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন, গুয়াতেমালায় ছিনতাইকারীর গুলি আর চুরির মুখােমুখিহয়েও ফিরে এসেছেন কৌশলে, শুধু কি তাই তিনি কিরগিস্তানের আলা আরচা পর্বত সামিটে উঠার সময় পা পিছলে পড়ে ছােট্ট একটা বুনো গাছের সাথে ঝুলে ছিলেন- উঁচু পর্বত থেকে ঝুলে যাওয়া শরীরের নীচে ছিল গহীন ফাঁকা যেখানে বাঁচার কোন উপায় ছিলনা কিন্তু বিধাতা তাকে বাঁচিয়েছে সেখানেও তার তারসহ অভিযাত্রীদের সহযোগিতার। তার আরও অনেক অজানা কাহিনী। নাজমুনইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সাথে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে, আফ্রিকাতে তিনমাস আলু খেয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থাকার রেকর্ড আছে তার। পথে গাছ থেকে গাছের সাদা অরেঞ্জখেয়েদুইদিন পর আফ্রিকাতে পানির পিপাসা মিটিয়েছেন। যেহেতু তিনি সড়ক পথে ভ্রমণ করেছেন দিনের পর দিন, সর্বোচ্চ টানা ৫৮ ঘণ্টা বাসে, কখনও ৪৮ ঘণ্টা, কখনও ৩৬ ঘণ্টা তাকে বাসে জার্নি করতে হয়েছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। এটা ভাবলে অবাক লাগে যখন টানা কখনও ১৫ দেশ কখনও ১৪ দেশ, কখনও ১৪ দেশ এভাবে তিনি তিন মাস চার মাস পাঁচ মাসের জন্য সড়ক পথে এক শহর থেকে আরেক শহরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করেছেন।
মিতব্যয়ী তিনি : খরচের বিষয়ে নাজমুন বরাবরই খুব স্পষ্টবাদী। যেহেতু সুইডেনে তিনি পড়াশোনা করতে গিয়েছেন ২০০৬ সালে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি খণ্ডকালীন কাজ করতেন। সামারে তিনি কখনও ১৭ ঘণ্টা কখনও ১৮ ঘণ্টা প্রচুর পরিশ্রম করে পয়সা জমাতেন শুধু ভ্রমণ করার জন্য। কম খরচে থাকতেন পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে, কখনােতাবু কর, কখনো কোচ সার্ফিং এর মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত তিনি নিজের যোগ্যতায় নিজের বলেই পৃথিবীর এতগুলো দেশ ভ্রমণ করেছেন। মানুষের যখন স্বপ্ন, ইচ্ছে, একাগ্রতা, চেষ্টা থাকে আর সেই মানুষ যদি পরিশ্রমীহয় তাহলে তাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। পৃথিবীর পথ তাকে পথ চিনিয়েছে। হাজারো অজানা জনপদ পৃথিবীর আনাচে কানাচের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। অনেক সময় বর্ডার ক্রস করতে না পেরে তাকে স্থানীয় অপরিচিত পরিবারের সাথে থাকতে হয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে তিনি জানতেন না একঘণ্টা পরে তার জীবনে আসলে কি ঘটবে। এভাবেই তাকে পৃথিবী ভ্রমণ করতে হয়েছে। তবে বিপদসংকুল পথে তিনি সবসময়কৌশলী ছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে তিনি আবার বের হয়ে পড়বেন পৃথিবীর পথে পথে তার পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার জন্য বাকি কয়েকটি দেশে। ৭০০ বছর আগে ইবনেবতুতা যখন বাংলা এসেছিলেন তখন তিনি কি ধারণা করেছিলেন তারই মত একজন উত্তরসূরী আজ পৃথিবীতে বিচরণ করবে আর যে কিনা আমাদের এই বাংলার একজন নারী- যিনি নিজ দেশের পতাকা হাতে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে শান্তির বার্তা এক পৃথিবী এক পরিবারের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য নেমে পড়েছেন।
নাজমুন আমাদের এক উজ্জ্বল মুখ : ‘নাজমুন নাহার’ আমাদের লাল সবুজের পতাকার তারকা। আমাদের এক উজ্জ্বল মুখ। যুগে যুগে নারীরা বাধা ডিঙিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমাদেরকে আলাে দেখিয়েছেন বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতার মত নক্ষত্র মানুষ। নাজমুন আজ এ প্রজন্মের নক্ষত্র মানুষ হয়ে উঠলেন আগামী প্রজন্মের জন্য। আমরা অভিবাদন জানাই আমাদের নাজমুননাহারকে তার এই বিরল কাজের জন্য। বাংলাদেশের পতাকা যেন বিশ্ব ইতিহাসে সর্বোচ্চ উচ্চতায় স্থান পায়নাজমুনের হাত ধরে।
বিএনএনিউজ/আমিন