ছাগলনাইয়া(ফেনী): অর্ধশত বছর কিংবা তারও বেশি সময়ের মধ্যে এবার বন্যার কারণে সবচেয়ে তীক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন পুরো ফেনীবাসী। দুই মাসের মধ্যে তিনবার বন্যা; সর্বশেষ ১৯ আগস্ট শুরু হওয়া বন্যা ছাড়িয়ে গেল সবকিছুকেই। পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া – এলাকা তিনটি পাশাপাশি। তিন উপজেলার প্রশাসনিক বিভাজন ঘুচিয়ে দিয়েছে বন্যা। তারপর যোগ হলো ফেনী সদর। সবশেষে দাগনভূঁইয়া ও সোনাগাজী। বলা চলে, একে একে ডুবে যায় পুরো ফেনী।
এদিকে শুক্রবার(৩০ আগস্ট) পর্যন্ত বন্যায় ফেনীতে ১৯জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে।
অনেকের ঘরের ভেতরের পানি নামলেও উঠানে ও রাস্তায় পানি রয়ে গেছে। বন্যাকবলিত জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় এখনও খাবার ও ওষধের সংকট বিদ্যমান। কারণ রান্নার চূলা পানির নিচে।বেশিরভাগ গ্রামের বাড়ি ঘর একতলা।
জেলার অধিকাংশ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল রয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগ দুই-তৃতীয়াংশ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত স্বজনরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার দিন কাটাচ্ছেন। বাইরের জেলাগুলো হতে বাসিন্দারা ত্রাণ,নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রি নিয়ে স্বজনদের খোঁজে ফেনী ছুটছেন।
ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় সব এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়া ফেনী সদর ও দাগনভূঁঞা উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ছোট ফেনী নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা হলেও ১৯৮৮ সালের পর এ ধরনের ভয়াবহ বন্যা আর হয়নি। তিন উপজেলায় প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও বসতঘরে বন্যার পানি ঢুকেছে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস এবং ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ কাজ চলমান রয়েছে।
বন্যাদুর্গত এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা ছিল উল্লেখযোগ্য।সারাদেশের মানুষ নিজনিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যা কবলিত এলাকার জন্য ত্রাণ ও অর্থ সাহায্য দিয়েছে।
ফেনীর স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন ছাড়াও ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে শত শত তরুণ হিউম্যান এইডস, ড্রিমটাচ বাংলাদেশ, একজন বাংলাদেশ, ফেনী ক্লাব ঢাকা, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, মাস্তুল ফাউন্ডেশনসহ বেশকিছু সংগঠন স্বউদ্যোগে স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে এবং শুকনো খাবার সরবরাহ করছে। দেশের বহু রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, স্কুল কলেজ , মাদ্রাসা ও মসজিদ কর্তৃপক্ষ চাঁদা তুলে ত্রাণ দিয়েছে ফেনীতে।
অনেক ত্রাণ সামগ্রি এখনও ফেনী জেলায় বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে।
বন্যার পানি কমে আসায় ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার গোপাল ইউনিয়নের বাসিন্দা হোসনে আরা বেগম সাতদিন পর নিজের বসতঘরে ঢুকতে পেরেছেন। বন্যার পানি আসার পর ছেলের বউকে নাতিসহ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে এতদিন ধরে তিনি বাড়ির আঙিনার মাচায় বসবাস করছিলেন।
গত ২৯ আগস্ট বাড়ির উঠানে জমে থাকা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে ষাটোর্ধ্ব এই নারী বলেন, ‘চিড়া-মুড়ি আর কত খাওয়া যায়? ঘরে চাল-ডাল আছে, কিন্তু চুলা নাই। সাতদিন পর ঘর থেকে পানি নেমেছে। কিন্তু চুলা এখনো পানিতে ডুবে আছে।’
ছাগলনাইয়ার উত্তর যশপুরের নাছির উদ্দিন জানান, প্রতিটি ঘরের ‘অধিকাংশ জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। যা আছে সেগুলো রক্ষার চেষ্টা করছি।’ স্টিল ও লোহার তৈরি জিনিসপত্রগুলো টিকে আছে।
ছাগলনাইয়ার গৃহিনী সাজু বেগম বলেন, ৮ দিন পর নিজের ঘরে ফিরেছি। তিনি জানান, একতলা সেমিপাকা ঘরটি পুরোটাই পানিতে ডুবে গিয়েছিল। যা কিছু সব শেষ। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।
বন্যায় ছাগলনাইয়া উপজেলার ৮০-৮৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর ভেতর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গোপাল ইউনিয়নের বাসিন্দারা। সেখানে সব মানুষের কাছে ত্রাণ যাচ্ছে না।
উপজেলার দুর্গাপুর মোড়ে একটি এমন একটি গাড়ির কাছে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের ত্রাণের প্যাকেট দেওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিলেন বৃদ্ধ আহমদ মিয়া। বললেন, ‘ঘরে খাবার নেই। বাড়ি ভেতরের দিকে হওয়াতে সেখান পর্যন্ত ত্রাণ তেমন পৌঁছায় না। তাই রাস্তায় এসেছি।’
পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায় বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণে, বিমান বাহিনী, বিজিবি, র্যাব স্পিডবোট, নৌকা ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে । এতে গ্রামের সড়ক থেকে একটু ভেতরে ভেতরে পানিতে আটকে থাকা পরিবারগুলো জীবন বাঁচাতে পেরেছে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ফেনীর ছাগলনাইয়ায় বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে তিনি ছাগলনাইয়া ও আশপাশ এলাকায় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।
পাশাপাশি ফেনীর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করেছেন নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। এ সময় উদ্ধার, ত্রাণ সরবরাহ ও চিকিৎসা কার্যক্রমে নিয়োজিত নৌ সদস্যদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
সরকারের ত্রাণ মন্ত্রাণালয় শুক্রবার জানিয়েছে, ১১ জেলার ৬৪টি উপজেলায় অন্তত ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে; আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৫৪ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ জন মানুষ। বন্যায় প্লাবিত জেলাগুলো হলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট।
সবচেয়ে বেশি ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে ফেনীতে। ১১ জেলায় বন্যায় মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৪তে দাড়িয়েছে। এছাড়া কুমিল্লায় ১৪ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, খাগড়াছড়িতে ১ জন, নোয়াখালীতে ৮ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন কক্সবাজারে ৩ জন এবং মৌলভীবাজারে ১ জন মারা গেছেন; নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে মোট ৫৬৭টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে। সেনাবাহিনী ও জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকরা সেখানে সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা নির্দেশনা দিয়েছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র শুক্রবার(৩০ আগস্ট) বলেছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে এ সময় এই অঞ্চলের মনু, খোয়াই, ফেনী, মুহুরি, গোমতী, তিতাস ইত্যাদি নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে এবং বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। এ সময় এই অঞ্চলের সাঙ্গু, মাতামুহুরি, কর্ণফুলী, হালদা ও অন্যান্য প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে।
তবে বন্যা পরবর্তী ডায়রিয়া ও চর্মরোগ যাতে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে যেতে না পারে সেজন্য স্থানীয় প্রশাসন সতর্ক রয়েছে বলে ফেনীর জেলা প্রশাসক গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। তবে এ বন্যায় পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়ার হাজার হাজার পরিবার নি:স্ব হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: ফেনীর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ দেড় হাজার পরিবারকে ত্রাণ দিল র্যাব-৭
শুক্রবার(৩০ আগস্ট) ছাগলনাইয়ায় বিএনপির পক্ষে ত্রাণ বিতরণ করে দলের কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস।
বিএনএ,এসজিএন