বিএনএ,ঢাকা, বিশেষ প্রতিনিধি: চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) এর জেনারেটর ব্যবহারের জন্য মজুদ করা প্রচুর জ্বালানি তেল (ডিজেল) কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়েছে! প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের দূঘটনা থেকে রক্ষা পেলেও বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তৎপর রয়েছে কর্তৃপক্ষ। ঘটনাটি পরিকল্পিত নাকি গাফেলতি, সে ব্যাপারে কেউ মুখ খুলছেন না। এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এক সপ্তাহ পরও কী পরিমাণ তেল কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে তা পরিমাপ করতে পারেনি।সিইউএফএ’এ তেল নিয়ে তেলেসমাতি কান্ড শ্রমিক-কর্মচারি-কর্মকর্তাদের মুখে মুখে। রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
সূত্র জানায়, গত ২৪ জানুয়ারি রাতে সিইউএফএল’ র কেন্দ্রীয় জ্বালানি ট্যাংক থেকে জেনারেটর ট্যাংকে নেয়ার জন্য পাম্প চালু করা হয়। কিন্তু পাম্পটি বন্ধ করা হয়নি। ফলে ট্যাংক উপচে পড়া প্রচুর তেল নালা দিয়ে রাঙ্গাদিয়া খাল হয়ে কর্নফুলী নদীতে গড়িয়ে যায়। সকালে কর্মকর্তাদের নজরে এলে পাম্পটি বন্ধ করা হয়।
বিষয়টি ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহীমকে জানানো হয়। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।ব্যবস্থাপনা পরিচালক নালায় জমে থাকা ডিজেল উত্তোলন করার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তার নির্দেশনায় হোসপাইপের মাধ্যমে পানি দিয়ে জমে থাকা ডিজেল নদীতে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ)’র অনুসন্ধান টিমের ধারণ করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কারখানার নালায় প্রচুর ডিজেল জমা হয়ে আছে। অপর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নালায় হোসপাইপ দিয়ে পানি দেয়ার পর প্রবাহিত তেলের আস্তরণ গাস ও আগাছায় জমাট হয়ে আছে।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে জিএম (এমটিএস) ইস্কান্দার সাবের আহমেদ, জিএম (টেকনিক্যাল) ছালে আহমেদ, জিএম (প্রশাসন) শহীদুল্লা খান, অতিরিক্ত প্রধান কেমিস্ট উত্তম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কেউ কোন তথ্য প্রদান করেনি। তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রহীমের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য পরার্মশ দেন। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকায় অবস্থান করায় টেলিফোনে যোগাযোগ করে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন জানান, দুর্ঘটনা বা অসাবধানে যদি জ্বালানি তেল নালায় পড়ে থাকে তা অপসারণ করা বাধ্যতামূলক। তা না করে যদি পানির প্রবাহ সৃষ্টি করে কর্ণফুলী নদীতে নিক্ষেপ করা গুরুতর অপরাধ। এ ধরনের কোন ঘটনা সংগঠিত হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল), কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড় এবং মোহনায় অবস্থিত। এ দুটি প্রতিষ্ঠান নদী দূর্ষণ করলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরদারি নেই বললে চলে। নদীর পানি বেশি থাকা এবং ভাটার টানে রাসায়নিক বর্জ্য সমূহ বঙ্গোপসাগরে দ্রুত মিশে যায়। ফলে বিভিন্ন সূত্রে দূর্ষণের খবর পেলেও তথ্য প্রমাণের অভাবে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না পরিবেশ অধিদপ্তর।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিইউএফএল’ এর জ্বালানি তেল নিয়ে তেলেসমাতির ঘটনা নতুন নয়। কারখানার জ্বালানি তেল নিয়ে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে অডিট আপত্তি দিয়েছেন বিসিআইসি’র উপ প্রধান নিরীক্ষক এস এম শাহনেওয়াজ। সুত্র নং-নিবিভা/ নিদখ/ সিইউএফএল/ ২০১৮-২০২০/৪৮ তারিখ ২২ ডিসেম্বর ২০২০ ( ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ স্বাক্ষরিত) আপত্তিপত্রে দেখা যায় সিইউএফএল এর টেকনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ফায়ার শাখার ৬ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ২টি পানিবাহী ফায়ার ট্রাকে প্রয়োজন ছাড়াই প্রতি মাসে নিয়মবর্হিভূতভাবে দুই শত লিটার করে চার শত লিটার ডিজেল প্রদান করা হয়। এছাড়া ১টি রেসকিউ গাড়িতে প্রতিমাসে ডিজেল প্রদান করা হয় ৯০ লিটার করে।
২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ফায়ার শাখার উক্ত তিনটি গাড়িতে ১১ হাজার ৬ শত ৭৫ লিটার ডিজেল প্রদান করা হয়। এতে কারখানার আর্থিক ব্যয় ৭ লাখ ৫৮ হাজার ৮শত ৫০ টাকা। গাড়ি সমূহের জ্বালানী ব্যয় লাগামহীন, ব্যয় নিয়ন্ত্রণের অভাব পরিলক্ষিত হয় আপত্তি পত্রে উল্লেখ করা হয়।
সুত্র নং-নিবিভা/ নিদখ/ সিইউএফএল/ ২০১৮-২০২০/৬২ তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ( ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ স্বাক্ষরিত) অপর একটি আপত্তিপত্রে দেখা যায়, প্রকৃত মাইলেজ এর ভিত্তিতে জ্বালানী তেল প্রদান না করে গাড়ি ব্যবহার হোক বা না হোক নিয়মবর্হিভূতভাবে থোক বরাদ্দ আকারে কারখানায় ব্যবহার করা বিভিন্ন যানবাহনে প্রতিদিন ৫ লিটার থেকে ২৫ লিটার পর্যন্ত অকটেন ডিজেল প্রদান করা হচ্ছে। কারখানায় জ্বালানি তেলের যথেচ্ছ ব্যবহার পরিলক্ষিত।২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে জ্বালানি তেল খাতে কারখানার মোট ব্যয় ২ কোটি ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৮শত ১০ টাকা।
অডিট আপত্তিতে বিসিআইসি’র উপ প্রধান নিরীক্ষক এস এম শাহনেওয়াজ উল্লেখ করেন, ভিজিলেন্স ডিউটির জন্য ভিজিলেন্স গাড়িতে প্রতিদিন ১৫ লিটার, ব্যাগিং শাখায় অফিসার আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহার করা গাড়িতে প্রতিদিন ২৫ লিটার, চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াতে প্রতি গাড়িতে প্রতিদিন ১৫ লিটার, পানিবাহি ফায়ার ট্রাকে প্রতিমাসে ২০০ লিটার, রেসকিউ গাড়িতে প্রতিমাসে ৮৫ লিটার এ্যাম্বুলেসে প্রতিদিন ৬ লিটার করে থোক বরাদ্দ আকারে জ্বালানি তেল প্রদান করা হচ্ছে। গাড়িগুলোতে জ্বালানি তেল প্রদানের ক্ষেত্রে প্রকৃত পক্ষে গাড়ি সমূহ কোন কোন ডিউটিতে কি পরিমাণ চলছে তা বিবেচনা করা হয় না। প্রশাসন বিভাগের সুষ্ঠ তদারকি ও তত্ত্বাবধানের অভাবে কারখানায় জ্বালানি তেল ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণের অভাব পরিলক্ষিত। জরুরি ভিত্তিতে কমিটি গঠন পূর্বক কারখানায় ব্যবহার করা বিভিন্ন যানবাহনে থোক বরাদ্দ আকারে তেল প্রদান বন্ধ করে প্রকৃত মাইলেজ এর ভিত্তিতে জ্বালানী তেল প্রদানের কার্যকরী উদ্যাগ গ্রহণ আবশ্যক বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
বিএনএনিউজ/ এইচ.এম।