।।আর করিম চৌধুরী।।
বিএনএ,ডেস্ক: দেশে প্রতিদিন শীতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে।শীত এদেশের মানুষের জীবনে অঘোষিত এক উৎসবের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে।শীতকাল আর পিঠা যেন একসূত্রে গাঁথা। পিঠা বাঙালির জীবন ও লোকজ খাদ্য সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ। তবে শরৎকাল থেকে পিঠার আসল সময় শুরু হয়। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অগ্রহায়ণে অর্থাৎ হেমন্তে নতুন ধান কাটার পর থেকেই মূলত পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়।কৃষকের ঘরে হেমন্তে নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পিঠা তৈরির কাজ।গ্রাম থেকে শহরে, সর্বত্র চলে পিঠা পায়েসের আয়োজন।তা চলতে থাকে শীতকালজুড়ে।
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় চুলোর পাশে বসে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটান গাঁয়ের বধূরা।অতিথি ও জামাইদের দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হয়।গ্রামের পাশাপাশি শহরেও পাওয়া যায় শীতের পিঠার সুবাস।প্রতিটি রাস্তায় পিঠা বানিয়ে বিক্রি করেন বিক্রেতারা।পুরো শীতকালজুড়েই শহরের পথে-ঘাটে বা ফুটপাতে পিঠা কেনাবেচা হয়।শীতের পিঠা তৈরিকে গ্রামাঞ্চলে উৎসব হিসেবে গণ্য করা হলেও শহরে খুব কমই চোখে পড়ে পিঠা-পুলির বাহার।
বাংলাদেশে ১৫০ বা তার বেশি রকমের পিঠা থাকলেও মোটামুটি ৩০ ধরনের পিঠা বেশি প্রচলিত।কালের গভীরে কিছু হারিয়েও গেছে।আবার কিছু নতুন আঙ্গিকে তৈরির পর পরিবেশিত হচ্ছে।দেশের একেক অঞ্চলে রয়েছে একেক রকম পিঠা। দেশের উত্তরাঞ্চলে পিঠার যে ধরন, তার থেকে আলাদা ধরনের মধ্যাঞ্চলের পিঠা। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পিঠা কিংবা পূর্বাঞ্চলের পিঠার মধ্যেও রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। আবার একই পিঠা একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত!
ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, রস পিঠা, ডিম চিতই পিঠা, দোল পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নকশি পিঠা, পাকান, আন্দসা, কাটা পিঠা, ছিটা পিঠা, গোকুল পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠি পিঠা,চাঁদ পাকান, সুন্দরী পাকান, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, পাতা পিঠা, বিবিখানা, চুটকি, সরভাজা, পুলি, পানতোয়া, মালপোয়া, মেরা পিঠা, মালাই, কুশলি, ক্ষীরকুলি, গোলাপ ফুল, লবঙ্গ লতিকা, ঝালপোয়া, ঝুরি, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নারকেলি, সিদ্ধপুলি, ভাজা পুলি, দুধরাজ ইত্যাদি কত কত ধরনের যে পিঠা!
শীতে খেজুরের রস পিঠাকে করে তোলে আরও রসালো ও সুস্বাদু।কিন্তু সব পিঠা তৈরিতে খেজুর রসের বা খেজুরের গুড়ের ব্যবহার করা হয় না।তবে যে পিঠাই তৈরি করা হোক না কেন, এর মূল উপকরণ চালের গুঁড়া।চালের গুঁড়া, নারকেল, খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয় ভাপা পিঠা। গোল আকারের এ পিঠা পাতলা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ঢাকনা দেয়া হাঁড়ির ফুটন্ত পানিতে ভাপ দিয়ে তৈরি করা হয়। এ কারণেই এর নাম ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে মাটির হাঁড়িতে বিশেষ উপায়ে তৈরি করা হয় চিতই পিঠা। অতি সাধারণ এই পিঠাটি গুড় বা ঝাল শুঁটকি ভর্তা দিয়ে খেতে খুবই মজা। এই পিঠাকেই সারা রাত দুধে বা খেজুরের রসে ভিজিয়ে তৈরি হয় দুধ চিতই বা রস পিঠা। গুড় গোলানো চালের আটা তেলে ছেড়ে দিয়ে যে পিঠা তৈরি করা হয়, তার নাম তেল পিঠা।আরেকটি চমৎকার পিঠা হলো নকশি পিঠা। এই পিঠার গায়ে বিভিন্ন ধরনের নকশা আঁকা হয় বা ছাঁচে ফেলে পিঠাকে নানা রকম নকশার আদলে তৈরি করা হয় বলেই এ পিঠার এমন নাম। নকশি পিঠা তৈরির জন্য প্রথমে আতপ চালের গুঁড়া বা আটা সেদ্ধ করে মণ্ড তৈরি করা হয়। এই মণ্ড বেলে মোটা রুটির মতো তৈরি করে তার ওপর বিভিন্ন নকশা করা হয়। রস পাকান তৈরি হয় শুকনো সুজি, ডিম আর চিনি দিয়ে। সারা দেশেই কুলি পিঠা বেশ জনপ্রিয়।সেইসঙ্গে গুড় দিয়ে তৈরি হালকা বাদামি অথবা চিনির তৈরি সাদা রঙের পাটিসাপটা আরেকটি সুস্বাদু পিঠা।
আর সময়ের পরিক্রমায় খেজুর গাছের সংখ্যা যেমন কমেছে ঠিক তেমনি খেজুরের রসের পাটালীর চাহিদা বেড়েছে বহুগুনে।কিন্তু এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে স্বাস্থ্যের জন্য পুরোপুরি ক্ষতিকর ও ক্যামিকেলযুক্ত ভেজালে পরিপূর্ন খেজুরের পাটালী গুড়ে বাজার সয়লাব।ভোক্তারা অনেকটা নিরুপায় হয়ে এইসব বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক গুড় খেয়ে অসুস্হ হচ্ছেন।আর শরীরে দীর্ঘমেয়াদী রোগ তৈরী করছেন।
বাজারে বেশীরভাগ খেজুর গুড়ে থাকে হাইড্রোজ,কৃত্রিম রং, ফিটকিরি, চিনিসহ নানা রকমের ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য। পুরোপুরি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এসব গুড় এক প্রকার বাধ্য হয়েই খাচ্ছে মানুষ।আর এত সস্তা দামের গুড় ক্রেতাকে সহজেই আকৃস্ট করে। কোনরুপ মান নিয়ন্ত্রনহীন ও লাগামহীনভাবে চলছে এই গুড় তৈরীর কার্যক্রম।
তবে, আসল খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।খেজুরের গুড় আখের গুড় থেকেও বেশি মিষ্টি, সুস্বাদু। ঘ্রাণ ও স্বাদের জন্য এ গুড়ের বিশেষ চাহিদা রয়েছে।খেজুরের গুড়ে আখের গুড়ের চেয়ে বেশি প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল আছে।
বিএনএনিউজ/এসজিএন