২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
রয়টার পরিবেশিত এক খবরে জানা যায়, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর নায়ক ইয়াহিয়া খান গত মঙ্গলবার ইরানের রাজধানী তেহরানে গিয়ে পৌঁছেছে। ওয়াকেবহাল মহল জানিয়েছেন, ইয়াহিয়া খান ইরানের শাহের সঙ্গে পাক-ভারত সম্পর্কে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করবে।
তেহরানের ইংরেজী দৈনিক ‘তেহরান জার্নাল’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার আরো জানিয়েছে, পাকিস্তান ও ভারতের বর্তমান সংঘাতে ইরানের মধ্যস্থতা করার সম্ভাবনা রয়েছে। পত্রিকায় আরো বলা হয়েছে, পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের সঙ্গে ইরানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান থাকায় ইরান দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে তৃতীয় যে কোন দেশের চাইতে অধিকতর ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারবে। পত্রিকাটিতে এমনও বলা হয়েছে, অক্টোবরে পারস্য সাম্রাজ্যের আড়াই হাজারতম বার্ষিকী অনুষ্ঠান ইয়াহিয়া খান ও ভারতীয় নেতাদের বৈঠকের একটি চমৎকার সুযোগ করে দেবে।
ঠিকই দিল ঢাকা থেকে এক বেতার ভাষণে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার লাটবাহাদুর গাদ্দার মালিক বলেছে যে, সে ভারতীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
দুটি খবরের উৎসস্থল তেহরান ও ঢাকার মধ্যে দূরত্ব অনেক-হাজার হাজার মাইল। কিন্তু আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে খবর দুটির সারসংক্ষেপে। ব্যাপারটা অদ্ভূত ঠেকছে অনেকের কাছেই। তবু একথা সত্য যে, সমস্যার কেন্দ্রভূমি বাংলাদেশ হওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়া ধর্ণা দিয়েছে ইরানের দরবারে, উদ্যেগ আয়োজন চলেছে ইয়াহিয়ার সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের বৈঠকের। আর এদিকে ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া গভর্নর মালিক বাস্ত্তচ্যুত বাঙালী শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনবার জন্য আলোচনা করতে চাইছে ভারতীয় মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে।
কিন্তু কেন? পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর এই আচরণের, ভারতের সঙ্গে আলাপ আলোচনার এত খায়েশ কেন?
বিশ্ববাসী জানেন ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ কোন বিরোধ নেই। আসলে সংঘাত চলেছে, যুদ্ধ চলেছে, শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশ এবং উপনিবেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর মধ্যে। রক্তপাত, বর্বরতা, লুটতরাজ নির্যাতন চলেছে বাংলার মাটিতে- এসব করছে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া ডালকুত্তার দল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে অমিতবিক্রমে লড়ে চলেছে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদস্যুদের বিরুদ্ধে। হানাদার বাহিনী নাপাম বোমা ফেলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে বাংলাদেশের জনপদ। স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করে রেখেছে জল্লাদ ইয়াহিয়া খান। লিপ্ত হয়েছে তার বিচার প্রহসনে। তাই সমগ্র বিরোধটা, মূল সংঘর্ষটা চলেছে বাংলাদেশের জনগণ আর পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। এর মধ্যে ভারতের স্থান কোথায়? ভারতের কথা আসে কিসে?
কিন্তু তবু গোড়া থেকেই জঙ্গীশাহী চেষ্টা করে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি বেমালুম চাপা দিয়ে বিশ্ববাসীকে এই মর্মে বিভ্রান্ত করতে যে সংঘর্ষটা আসলে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। এর উদ্দেশ্যও পরিস্কার। জঙ্গীশাহী চাইছে পাক-ভারত সংঘর্ষের ডামাডোলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে। ইয়াহিয়া চাইছে বাংলাদেশ ইস্যু থেঁকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কল্পিত পাক-ভারত বিরোধের দিকে সরিয়ে নিতে। আর সে কারণেই তেহরানের দুয়ারে ধর্ণা।..
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র -৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ১১৩) চলবে।
আরও পড়ুন :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৫
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা