বাইরে যে ছোট বসার জায়গাটি আছে তার উপর বসেই চুপ করে আছি। জমাদার সাহেব এসে বললেন, চিন্তা করে শরীর নষ্ট করবেন না । দুই একজন কয়েদিও পাশ দিয়ে ঘুরে গেল, সাহস করে কিছুই বলল না । এইভাবে অনেক সময় কেটে গেল । ৯টার সময় ডিপুটি জেলার সাহেবকে খবর দিলাম আমার সাথে দেখা করার জন্য । তিনি খবর পেয়েই চলে এলেন। তাকে বললাম একটা টেলিগ্রাম করতে চাই চীফ সেক্রেটারির কাছে, এই কথা বলে, মায়ের শরীর খুবই খারাপ আমার গ্রামের বাড়িতে যদি সম্ভবপর হয় আমাকে ছেড়ে দিতে পারেন ।’ তিনি বললেন, দিয়ে দেন, আমরা তো পাঠাবার মালিক ।
টেলিগ্রাম লিখে পাঠাইয়া দিলাম । জানি কি হবে! এরা আমাকে ছাড়বে না । পরে বলবে, সরকারকে তো জানান হয় নাই। তাই জানাইয়া রাখলাম ।
ইত্তেফাক কাগজেও মায়ের অসুখের কথা উঠেছে। অনেক চেষ্টা করি, চিন্তা করব না। তবুও বার বার একই কথা মনে পড়ে। আমার মার প্রত্যেকটি কথাই আমার মনে পড়তে থাকে
পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেই ১৯৪৮-এ যখন আমাকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার করল, আবার ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ সালে ছাড়ল, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস এদেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?’
বলতে পারেন, আমার এই গ্রাম্য মা’র কথার কি জবাব দিব? বললাম ‘মা তোমাকে পরে বলবো । কোনো কিছু বলার আমার ছিল কি? একদিন সুযোগ বুঝে মার কাছে অনেক কথা বললাম, মা কি বুঝতে চায়! আমার মাকে কোনোদিন বোঝাতে পারি নাই। মাঝে মাঝে আমাকে বলত, ‘যে তোকে জেলে নেয় আমাকে একবার নিয়ে চল, বলে আসব তাকে মুখের উপর । আমার ভাইবোনেরা সকলেই হাসতো মা’র কথা শুনে। আজ মার অনেক কথাই আমার মনে জাগছে।
দৈনিক খবরের কাগজগুলি এল, দেখলাম কাগজগুলিকে সরকার সংবাদ সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায়ই প্যামফ্লেট করে রেখেছে। কোনো সংবাদই নাই এই আন্দোলনের ।
জেলের কয়েদিদের খবর হলো, ‘হাজার লোকের উপর মারা গেছে পুলিশের গুলিতে’—এমন অনেক খবর রটছে । সত্য খবর বন্ধ হলে অনেক আজগুবি খবর গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে, এতে সরকারের অপকার ছাড়া উপকার হয় না । আজ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা, যারা বাইরে আছেন যদি সঠিক
নেতৃত্ব দিতে পারেন তবে দাবি আদায় করতে বেশি সময় লাগবে না । লেখাপড়ায় আজ আর মন দিতে পারলাম না । কখন যে তালাবন্ধ করে চলে গিয়াছে সে খবরও আমার জানা নাই, কারণ সন্ধ্যার একটু পূর্বেই ঘরে চলে।
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৭৮-৭৯, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
পড়ুন আগের পর্ব :
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী,এসজিএন