বিএনএ,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নে ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি আমান উল্লাহ আনুকে অপহরণ করে হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলে। পরে সেই লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আর এর নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদ, তার ছোট ভাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর কবিরসহ আরো ১০ জন। এছাড়াও এই ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রয়েছে খুন ঘুম, দখলসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ।
এদিকে গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। নিহত আমান উল্লাহ আনুর বড় বোন মমতাজ বেগম মামলাটি দায়ের করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে আনোয়ারা থানাকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলায় ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ, তার ভাই আলমগীর কবির ছাড়াও আরও ৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন আমিরপাড়ার ইসমাইল (২৫), প্যানেল চেয়ারম্যান আরফাতুল ইসলাম এমরান (৩৫), পুতু চৌধুরী (৪৫), মৎস্যজীবি লীগের সভাপতি আবদুল আজিজ টিপু (৩৫), আবদুল মোমেন (৩০), আবদু সাত্তার (৩৫), মো. হেলাল উদ্দিন (৩২), এবং রোজিনা আক্তার (৩৫)। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আসামিরা সকলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং একটি অপহরণকারী চক্রের সদস্য।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম শহর থেকে বাঁশখালী ফেরার পথে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে আমান উল্লাহ আনুকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের পর তাকে একটি অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয় এবং মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অপহরণের পর আনু নিখোঁজ হয়ে যায়, এবং ১২ ফেব্রুয়ারি আনোয়ারা থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। পরে ২০ ফেব্রুয়ারি এক গোপন নম্বর থেকে ফোন করে মুক্তিপণের দাবি জানানো হয়, কিন্তু মুক্তিপণ দেওয়ার পরও আমান উল্লাহ আনুকে ছাড়া হয়নি।
মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, মমতাজ বেগম ২০১৯ সালের ৪ মার্চ চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি বরাবর অভিযোগ করেন। সেখানে কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় পরবর্তীতে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। পিবিআই মামলাটি এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করে আনোয়ারা থানাকে তদন্তভার গ্রহণের পরামর্শ দেয়। আসামিদের হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে বাদী তদবির করতে না পারায় মামলাটি পরবর্তীতে ২০৩ ধারায় খারিজ হয়।
এরপর ২০১৯ সালের ৩ মার্চ আনুমানিক ১২ টা ৩০ মিনিটে আমান উল্লাহ আনুকে ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চেয়ারম্যানের নির্দেশে তাকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাদী মমতাজ বেগম জানান, আসামিরা আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তিনি বলেন, স্থানীয়রা তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলায় সাক্ষী হতেও ভয় পায়। তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। তাই আমার পরিবার ঘটনার ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আসামিদের ভয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সাহস পায়নি। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের পতনের পর তাদের সন্ত্রাসী, গুম-খুনের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় আমি ভাই হত্যার বিচারের আশায় অনেক দিন পর মামলা দায়ের করলাম।
বাদী মমতাজ বেগমের প্রধান আইনজীবী রফিকুল হক জানান, মামলার শুনানিতে তিনি ও ডজনখানেক আইনজীবী অংশগ্রহণ করেন। শুনানি শেষে আদালত সন্তুষ্টি প্রকাশ করে আনোয়ারা থানাকে মামলাটি এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দেন।
হারুন চেয়ারম্যানের অতীত:
দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ৩১ জেলে হত্যার ঘটনায় আলোচিত ‘চরিত্রের’ নাম বিতর্কিত চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশিদ। যার বিরুদ্ধে শুধু বাঁশখালী নয়, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় আছে সাংবাদিক অপহরণ, শিশু ধর্ষণ, সরকারি বনভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ ফৌজদারি অভিযোগে অন্তত ১২টি মামলা। এর মধ্যে চারটি থেকে খালাস পেলেও বাকি আটটি মামলা বিচারাধীন। সম্প্রতি ৩১ জেলে হত্যা মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছে আদালত।
২০২০ সালের ২ আগস্ট বাঁশখালীর এক স্থানীয় সাংবাদিক মো. বেলাল উদ্দিনকে অপহরণ করেন চেয়ারম্যান এম হারুনুর রশিদের সহযোগিরা। জন্ম নিবন্ধন ইস্যু করতে অতিরিক্ত ‘ফি’ নেওয়ার বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার জের ধরে বেলালকে অপহরণ করে হারুনের সহযোগী আশেক, মিয়া হোসেন, ছৈয়দুল মোস্তফা ওরফে বাক্কা, এমদাদ, নজরুল সিকদার, শাহাবুদ্দিন রাকিব, আশরাফ হোসাইন। বিষয়টি জানার পর তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের হস্তক্ষেপে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা এক ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিক বেলালকে হারুনের বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় হারুনের ৫ সহযোগীর বিরুদ্ধে বাঁশখালী থানায় মামলা হয়। এজাহারে হারুনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও তাকে আসামি করা হয়নি। এর আগে ২০১৫ সালে আবু সিদ্দিক নামের এক শিক্ষককে অপহরণের অভিযোগ উঠে হারুন বাহিনীর বিরুদ্ধে।
এদিকে ১৯৯৮ সালে ১২ বছর বয়সী কাজের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয় হারুনের বিরুদ্ধে। হারুন ১৯৯৭ সালে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল প্রথম ও ২০২২ সালের ১৫ জুন দ্বিতীয় বার ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান হারুনের সহোদর মো. আলমগীর, সহযোগী মোহাম্মদ ইউনুছের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগে আছে মামলায়। এরমধ্যে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর ইউনুছ র্যাবের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
চেয়ারম্যান হারুন ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে বনবিভাগের জমি, চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠসহ সরকারি-বেসরকারি ১২ হাজার ২২৫ শতক জমি দখল, নকল স্বর্ণ ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অভিযোগ আছে। তার বিরুদ্ধে বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পাঁচলাইশ থানায় ধর্ষণসহ অন্তত ১২টি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া অনেকবার সাধারণ ডায়েরিও করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি চারটি মামলায় খালাস পেলেও অন্য বিচারাধীন মামলাগুলোতে জামিনে আছেন। হারুন বাহিনীর প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই মানব পাচার, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন, হত্যাসহ সাত-আটটি মামলা চলমান রয়েছে।
ছনুয়ার আইনজীবী আতার উল্লাহ চৌধুরী, আব্দুর ছবুর, মো. সরোয়ার, মোজাম্মেল হকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি বলেন, ‘সন্ত্রাসী হারুন ২০১৭ সালে ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর থেকে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বহুমাত্রায় বেড়ে গেছে। আমাদের পৈত্রিক ১২ হাজার ২২৫ শতক চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ দখল করেছে সে ও তার লোকজন।
উপকূলীয় বনবিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চেয়ারম্যান হারুন বনবিভাগের ৪০০ কানি জায়গা দখল করে রেখেছেন। জানা গেছে, চেয়ারম্যান ও তার বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ গ্রামবাসীর দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে র্যাব অভিযান চালালে হারুন বাহিনীর অন্যতম সদস্য মো. বাহাদুর ওরফে বাহাদুর ডাকাত, নুরুল আলম, মো. হোসাইন ও আবু তালেব র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। কিন্তু তারপরও হারুন, তার ভাই আলমগীরসহ হারুন বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জমি দখল, চাঁদাবাজি থেমে ছিল না।
বিএনএনিউজ/নাবিদ/এইচমুন্নী