বিএনএনিউজ: নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এ নয় মাস যুদ্ধকালীন সময়ে বাঙ্গালি জাতিকে অনেক বেশি ত্যাগ করতে হয়েছে। বিশেষ করে এসময় বিভিন্ন ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন নারীরা। যেসব নারী নির্যাতিত হয়েছে তাদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রায় ২-৪ লক্ষ নিরীহ নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষিত হয়।
১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধকালীন সময়ে ধর্ষিত নারীদের বীরঙ্গনা খেতাব প্রদান করে। রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমান “পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত নারীদের যথাযোগ্য সম্মান এবং মর্যাদা” দেবার জন্য বাংলাদেশকে আহ্বান জানান এবং বীরাঙ্গনাদেরকে নিজের মেয়ে হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে সবচেয়ে হতাশার বিষয় অনেক বীরাঙ্গনারই কোন খোঁজ নেই। অনেকে সামাজিক বৈষম্যের ভয়ে পরিচয় আড়াল করে পার করে দিয়েছেন জীবন। অনেকে হতাশা নিয়েই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন।
‘দ্য চেঞ্জিং ফেস অব জেনোসাইড’ বইতে ড. জিওফ্রে ডেভিস জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রতিটি থানায় প্রতিদিন গড়ে দু’জন করে মেয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। থানার সংখ্যা ৪৮০টি এবং দখলদারিত্ব স্থায়ী হয়েছিল ২৭০ দিন। ৪৮০কে ২৭০ ও ২ দিয়ে গুণ করে পাওয়া যায় ২ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ জন। অন্যান্য কারণেও মেয়েরা নিখোঁজ হয়েছেন ধরে সংশ্লিষ্ট বোর্ড সংখ্যাটাকে এনেছেন দুই লাখে। অথচ এর মধ্যে মাত্র ২৫০ জনকে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে!
বীরঙ্গনা বলা হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেওয়ার দাবি উঠে নির্যাতনের শিকার হওয়া এসব নারীদের। ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি আদেশের পর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পর ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। পরের বছরের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ওই প্রস্তাব পাস হয়। ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এমন একচল্লিশ জন নারীকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয় সরকার। এই নারীদের গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে বীরাঙ্গনা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এই প্রথমবারের মতো তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও আত্মত্যাগের জন্য সরকার আরও ৬১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ পর্যন্ত ৪০০ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছেন।
প্রথম তালিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়াদের একজন সিরাজগঞ্জের মোছাম্মৎ সূর্য বেগম। মাত্র ১৫ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর আজ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে সূর্য বেগম এদিন খুবই আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার নারীদের একটি বড় অংশ ছিলেন গ্রামাঞ্চলের। ফলে সেখানকার রক্ষনশীল সমাজে বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনা করা হয়, অনেক পরিবারে এ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনাও হয় না।
কিন্তু সূর্য বেগমের চার সন্তানের সবাই তাদের মায়ের জন্যে গর্বিত বলেই জানান তাঁর ছেলে মোঃ হাফিজুর রহমান। একই সাথে তিনি খুশী মায়ের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির পাওয়ার বিষয়টিতে।
আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলেয়া বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল মাত্র ১৩৷ কিন্তু তিনিও রেহাই পাননি পাক সেনাদের হাত থেকে৷ প্রায় সাত মাস, প্রতিদিন, কয়েকবার করে ধর্ষিত হয়েছেন তিনি৷
শুধু ধর্ষণ নয়, সিগারেট দিয়ে তাঁদের মুখ সহ সারা শরীরে ছেঁকা দেয়া হতো৷ আর খাবার হিসেবে দেয়া হতো শুধু শুকনো রুটি৷ মাঝেমধ্যে সবজি৷ ফলে অনেক মেয়ের শরীর সাঙ্ঘাতিক খারাপ হয়ে যেত৷ যখন পাক সেনারা দেখতো কোনো মেয়েকে দিয়ে আর হচ্ছে না তখন তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হতো৷ যেমনটা করা হয়েছিল আলেয়ার ক্ষেত্রেও৷ কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান৷
আলেয়ার দুঃখ, যুদ্ধের পর সমাজ তো তাঁদের মেনেই নেয়নি, উল্টো খারাপ কথা শুনতে হয়েছে তাঁদের৷
পরবর্তীতে নিজের তিক্ততম অভিজ্ঞতা লুকিয়ে বিয়ে করেন আলেয়া৷ কিন্তু কয়েক বছর আগে স্বামী সেটা জেনে তাঁকে মারধর করে এবং বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়৷ তবে মেয়ে বাধা দেয়ায় সেটা আর সম্ভব হয়নি৷
এক সাক্ষাৎকারে আলেয়া বলেন, ‘‘আমি অনেক কষ্টে আছি৷ কেউ আমাদের খবর নেয়না৷ এই কথা কারও কাছে বলতে ভাল লাগেনা৷”
আলেয়ার বোন লাইলিও একজন বীরাঙ্গনা৷ পাক সেনারা যখন তাঁকে ধরে নিয়ে যায় তখন তিনি সন্তানসম্ভবা৷ কিন্তু পরে সেই সন্তান মারা যায়৷ পরবর্তীতে লাইলি পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন৷ কিন্তু বিনিময়ে তিনি কী পেয়েছেন? জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘‘মানুষের লাঞ্ছনা, ঘৃণা, অপবাদ আর ঘাড় ধাক্কা৷”
আরেক বীরাঙ্গনা কমলা রানী থাকেন সাভারে। তিনি বলছিলেন, আমি বীরাঙ্গনার মানে জানি না। তবে, যুদ্ধের পর বুঝেছি, ভালো কোনও নাম দেওয়া হয়নি আমাদের। যুদ্ধের কয়েক মাস পর আমাকে ধরে নিয়ে গেল, নির্যাতন করল পশুর মতো, মরারও কোনও পথ রাখেনি সেই ক্যাম্পে। দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকে রক্ত বের করেছি। মরিনি। কিন্তু স্বাধীনের পর মরে গেলাম। পরিবারে ঠাঁই হলো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পেটে যাকে ধরেছিলাম, তাকে শেকড়-বাকড় খেয়ে মারলাম ঠিকই। কিন্তু সমাজে ফেরা হলো না। তাহলে পেটেরটারে মারলাম কেন? সে থাকলে আপন কেউ থাকত আমার।’
সাভারে এক গ্রামে ছাপড়া ঘরে থাকেন কমলা রাণী। ভিখারিনী হিসেবেই সবাই তাকে চেনেন। আগে ঢাকায় বাসাবাড়িতে কাজ করেছেন। এখন আর কাজ করতে পারেন না। এলাকার মানুষ জানেন, তিনি নদীভাঙনে সব হারিয়েছেন। কমলা রাণী ঢাকায় যে বাসায় কাজ করতেন, সে সব বাসার সবাই এখন প্রবাসী।
বলেন, ‘আমার নাম কমলা রাণী, হিন্দু, বাড়ি কোথায় ভুলে গেছি। যুদ্ধে নির্যাতনের পরে নিজের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট সবচেয়ে বেশি কাঁদিয়েছে জীবনে। যারা আমার সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে, তারাতো আপনজন ছিল না, কিভাবে কেড়ে নিয়েছে, তা আমার আপনজনেরা তা জানতেন, দেশের মানুষ জানতো। তারপরও আমার জায়গা হলো না কোথাও! স্বাধীন হয়ে এত নীচু মনের হয়ে গেলাম আমরা! বাবা বলেছিলেন, দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি, তোমাকে সাথে নেওয়া যাবে না। বেঁচে থাকলে ভালো থেকো। সেই কথাগুলো আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। কিন্তু বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির এমএ হাসান দাবি করেন, ‘১৯৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬২ হাজার ধর্ষিত নারী এবং আরও ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ তাদের মধ্যে ৫ হাজার জনের গর্ভপাত সরকারিভাবে ঘটানো হয়েছিল বলে জানান আন্তর্জাতিক প্লানড ফাদারহুড প্রতিষ্ঠানের ড. জিওফ্রে ডেভিস। তার ভাষ্য, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই দেড়লাখের বেশি নারীর ভ্রূণ স্থানীয় দাই, ক্লিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে, সেভাবে নষ্ট করেছে।
অনেক বীরাঙ্গনারই নেই কোন খোঁজ। তারা পার করছেন মানবেতর জীবন যাপন। যদিও কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের খোঁজে বের করার কাজ শুরু করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ফিরোজা বেগম বলেন, অনেকেই কান্না করে, কিন্তু তাদের কেউ দেখা না। তাদের জন্য আমি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত আবেদন করেছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় স্বীকৃতি দিতে যথেষ্ট গড়িমসি করছে।
ফিরে দেখার সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা সাকিল বলেন, আরও অন্য সব জেলা থেকে বীরঙ্গনাদের খুঁজে বের করে সম্মাননার ব্যবস্থা করব।
প্রবাসী কবি সিনথিয়া খানের ‘প্রজাপতি মন’ কাব্যগ্রন্থের বিক্রয়লব্ধ অর্থে বীরঙ্গনাদের জন্য এ আয়োজন করেছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘ফিরে দেখা’।
বিএনএনিউজ/ হাসান মুন্না।