।। বাবর মুনাফ ।।
গত ২১ মার্চ বাংলাদেশের সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের বিরুদ্ধে সাবেক আইপিও প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘রিফান্ড আওয়ামী লীগ’কে রাজনীতিতে ফেরানোর অভিযোগ জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন আধা সরকারি খ্যাত নয়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। এই ঘটনায় সারাদেশে হৈ-চৈ পড়ে যায়। ওই পোষ্টে গত ১১ মার্চ সেনা সদর দপ্তরে সেনা প্রধানের সঙ্গে স্বাক্ষাৎকালে যে সব কথা হয়েছে, তা তুলে ধরেছেন বলে উল্লেখ করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। ২১ মার্চ তোলপাড় করা পোস্টটি দেওয়ার আগে বেশ হোম ওয়ার্ক করেছে এনসিপি’র এই নেতা। এর প্রমাণ মিলে ১৯ মার্চ আরেক সমাবেশ থেকে সেনা প্রধান ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন হাসনাত।
এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর ২১ মার্চের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে যখন দেশ-বিদেশে সমালোচনার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে, তখন ২৩ মার্চ এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ অর্ধশতাধিক লোকজনের এক সমাবেশ থেকে সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছাত্র-জনতা সেনানিবাস গুড়িয়ে দিবে।
কিন্তু সব আগুনই বরফ চাপা পড়েছে, হাসনাত আব্দুল্লাহ’র সঙ্গে ১১ মার্চ সেনা সদরে যাওয়া এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মূখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের পোস্টে।

সারজিস তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “যে ভাবে এই কথাগুলো ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে, এই প্রক্রিয়াটি আমার সমীচীন মনে হয়নি।” হাসনাত দাবি করেছিলেন যে, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ়-জ়ামান নতুন রূপে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং ওই প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন। সারজিস অবশ্য সেনাপ্রধানের এই সংক্রান্ত প্রস্তাবে কোনও ‘চাপসৃষ্টির বিষয়’ দেখেননি। তিনি জানিয়েছেন যে, সেনাপ্রধান তাঁদের বলেছেন, “যদি সংশোধিত আওয়ামী লীগের উত্থান না-হয়, তবে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের সমস্যা হবে।”
সারজিসের ওই পোস্টে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘এসব কী ভাই! পাবলিকলিই বলছি, দু’জনের একজন মিথ্যা বলছেন। এটা চলতে পারে না। মানুষ এনসিপিকে নিয়ে যখন স্বপ্ন বুনছে, তখন এভাবে এনসিপিকে বিতর্কিত করা কাদের এজেন্ডা!” কেউ কেউ লেখেন, “ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য রাজনীতি করবেন না।”
এদিকে এনসিপি দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর সেনানিবাসে বৈঠক নিয়ে স্ট্যাটাস প্রসঙ্গে দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেছেন, সেটি ‘শিষ্টাচার বর্জিত’ হয়েছে। গত ২২ মার্চ শনিবার বিকেলে সিলেটে ইফতার মাহফিলে যোগদানের আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
এর আগে ২১ মার্চ শুক্রবার এক ফেসবুক পোস্টে এনসিপি’র মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে সেনা জনতার অভ্যুত্থানের ফসল লুটকারী হিসেবে মন্তব্য করেন। একই স্ট্যাটাসে তিনি রাজনীতিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পুনর্বাসন নিয়েও অস্বস্তিকর মন্তব্য করেন। নাসিরের দেওয়া ওই স্ট্যাটাসের যখন কড়া সমালোচনা হচ্ছে তখন তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন।
প্রসঙ্গত, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। দলটির একাধিক শীর্ষ পদে আসেন জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা। দলের আহ্বায়ক হন নাহিদ ইসলাম। নতুন দলের এক মাস পূর্তি এখনও হয়নি। তার আগেই হাসনাত- সারজিসের পরস্পর বিরোধী এই দুই পোস্টকে কেন্দ্র করেই নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র মতানৈক্যের দিকটি প্রকাশ্যে এসেছে।
শুধু দলের ভিতরে নয়, জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির অভিভাবক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে দেওয়া ফেসবুক পোস্টকে নিয়ে দেশ-বিদেশে বেশ চাপে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এনসিপি’ নেতারা সরকারের যে পৃষ্ঠপোষকতা এতদিন পেয়ে আসছিলেন তা অনেকটা সংকুচিত হয়ে পড়বে। মূখ ফিরিয়ে নিতে পারে দলটির শিল্পপতি চাঁদাদাতারাও।
আধা সরকারি রাজনৈতিক দলের তকমা পাওয়া এনসিপি দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতে গিয়েও মাঠ পর্যায়ে বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপির রোষানলে রয়েছে দলটি। গত ২৪ মার্চ (সোমবার) নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা বাজারে পথ সভা করেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। সেই পথসভায় সন্ধ্যা ৭ টায় হামলার প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচীতে রাত সাড়ে ৯ টায় দুই দফায় স্থানীয় বিএনপির লোকজন হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন তিনি। এতে হান্নান মাসউদসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়। সব মিলিয়ে চরম রাজনৈতিক সংকটে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি।
বিএনএ নিউজ টুয়েন্টিফোর