বিএনএ, ডেস্ক :২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিট। পিলখানায় সাবেক বিডিআর ও বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তরের দরবার হলে চলমান বার্ষিক দরবারে একদল বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিক ঢুকে পড়ে। সিপাহি মঈন নামে একজন বিডিআর সদস্য মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। দুইদিন ধরে চলে এই নৃশংসতা। কেন, কীভাবে ঘটেছে দেশের নিয়মিত একটি বাহিনীর মধ্যে এমন নৃশংসতা? চলুন ফিরে দেখি।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীসহ একদল সেনা কর্মকর্তার সরাসরি হস্তক্ষেপে বিএনপি সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ড. ইয়াজউদ্দিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় । পরবর্তীতে গঠিত হয় ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন কথিত সুশীল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সময় বাংলাদেশ রাইফেলস পরিচালিত সল্প-আয়ের জন সাধারণের জন্য কম দামে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই ব্যবসায়িক প্রকল্পের লভ্যাংশ নিয়েই ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার হল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।
এছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিডিআর সদস্যদের একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ছিল। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয় তৎকালীন বিডিআর নেতৃত্ব।
এক পর্যায়ে বিডিআরের বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর বীভত্স ঘটনার সৃষ্টি হয়। এ সময় তারা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিজিবির সদর দপ্তর পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর কোনো বাহিনীর বিদ্রোহের ইতিহাসে নেই।
এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানার তত্কালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবোজ্যোতি খীসা একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)র বিশেষ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ মামলাটি তদন্ত করেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন ২০০ কর্মকর্তা। ৫০০ দিন তদন্তের পর ২০১০ সালের ১২ জুলাই আদালতে হত্যা এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। এতে ৮২৪ জনকে আসামি করা হয়।
পরে অধিকতর তদন্তে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে বর্ধিত অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দিন পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীসহ সব মিলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫০। বিচার চলার সময় চারজন মারা গেছেন। আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৫২ জন বিডিআর জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরো ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জন জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। যাবজ্জীবন দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় আরো ২০০ জনকে। খালাস পান ৪৫ জন। নিম্ম আদালতে মামলাটি শেষ হলেও উচ্চ আদলতে মামলাটি চলমান রয়েছে।
নিম্ম আদালত পিলখানা হত্যাকান্ড সর্ম্পকে পর্যবেক্ষণে বলেন, অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচি একটি বড় কারণ। কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী যেমন সেনাবাহিনী বা আধা সামরিক বাহিনী বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে অপারেশন ডাল-ভাতের মতো কাজে যুক্ত রাখা উচিত নয়।
পিলখানার ভেতরে স্কুলগুলোতে বিডিআর জওয়ানদের সন্তানদের ভর্তি করতে পারার বিষয়ে আরও ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে আরও স্কুল তৈরি করা যায় কি না, তা কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত।
সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মতো বিডিআর সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানো যায় কি না, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ভেবে দেখতে পারেন।
এ ছাড়া সেনাসদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে বিডিআর সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। এ জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ২০ শতাংশ ভাতা তাঁদেরও পাওয়া উচিত। তাঁদের ঝুঁকিভাতা দেওয়া যায় কি না, তাও দেখা উচিত।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক আরও বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের কারণ হিসেবে সামরিক নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কারণ থাকতে পারে; যাতে আমাদের সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করা যায়। কূটনৈতিক কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীকে উচ্ছৃঙ্খল দেখানো, যাতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশে গন্ডগোল থাকলে বাহিনীর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা থাকবে। এতে বিনিয়োগ হবে না। অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দুর্বল করার জন্য হতে পারে। সামাজিক কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীকে নিরুত্সাহিত করার জন্য এমন নৃশংস হত্যাকান্ডের নেপথ্য কারণ থাকতে পারে বলে আদালত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে।
প্রতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি এই দিবসটি স্মরণ করতে এসে নিহতদের স্বজনরা বনানীর সামরিক কবরস্থানে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড যাদের ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয়েছে সেসব কুশীলব বা ষড়যন্ত্রকারীরা পর্দার আড়ালেই থেকে গেল। তারা কারা এখনো তা জানা যায়নি।
প্রসঙ্গত, পিলখানায় নারকীয় হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তাদের নিহতের ঘটনায় দণ্ডবিধি আইনে করা হয় হত্যা মামলা। অপরটি হয় বিস্ফোরক আইনে। বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলাটি ১৫ বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যে আটকে আছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি। এই মামলায় আসামি রয়েছেন ৮৩৪ জন। এর মধ্যে একজন বেসামরিক ব্যক্তি, বাকি আসামিরা বিডিআরের জওয়ান। এই মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন। জীবিত আসামি ৭৯০ জন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন। পলাতকদের ধরিয়ে দিতে বিজিবি সারা দেশে ‘অপারেশন র্যাবল হান্ট’ নামে অভিযান চালিয়ে একজনকেও আটক করতে পারেনি। মামলায় এ পর্যন্ত ২৭৩ জন সাক্ষী দিয়েছেন।
মামলার বিচার কার্যক্রম সর্ম্পকে মামলার পাবলিক প্রসিকিউশন (পিপি) মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, বিস্ফোরক মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় ১ হাজার ২০০ জন সাক্ষী রয়েছেন। মামলায় এখন পর্যন্ত ২৭৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছরের মধ্যে আশা করছি আরো শ দুয়েক সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হবে। আসামিপক্ষ যদি সহায়তা করে, তাহলে এ বছরেই এই মামলার রায় দিতে পারবে আদালত এমনটাই জানান পাবলিক প্রসিকিউশন।
বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী, ওজি