বিএনএ, ঢাকা:জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা একের পর এক সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত তাঁর দুই স্ত্রী, সন্তান, ভাই–বোনসহ নিকটজনদের নামে ছয় জেলায় জমি, ফ্ল্যাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রিসোর্টসহ নানা সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর বাইরে পুঁজিবাজারেও তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে।
রোববার(২৩ জুন) মতিউর রহমানকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই দিন মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আলোচিত এই কর্মকর্তা ও তাঁর স্বজনদের এখন পর্যন্ত ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও মিরপুরে ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক।
উল্লেখ্য,এবার ঈদুল আজহার সময় এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। ছেলের বিলাসী জীবনযাপনের সূত্র ধরেই মতিউরের সম্পদের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের কাউকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। ঈদের পর কর্মস্থলেও যাননি তিনি। এসব সম্পদের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
প্রথম স্ত্রীর লায়লার সম্পদ
নির্বাচনের হলফনামায়, পেশা ব্যবসা।স্বামীর নাম উল্লেখ না করে বাবার নাম উল্লেখ করেছেন।২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর বিবরণীতে মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজ তাঁর মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ব্যাংকে নগদ ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ।পুঁজিবাজারের শেয়ার ১ কোটি ৬৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা মুনাফা উল্লেখ করেছেন।
গাজীপুর, নরসিংদী, যশোর ও নাটোরে মোট ৮৪৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ (২৫ দশমিক ৭০ বিঘা) জমি । ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডের এক ভবনে চারটি ফ্ল্যাটের নম্বর উল্লেখ করেছেন। একেকটির আয়তন ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ বর্গফুট। নির্মাণের শুরু থেকে হস্তান্তর পর্যন্ত প্রতি বর্গফুট সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। চারটির দাম ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর বাইরে আরও একটি ফ্ল্যাট সাড়ে ৫৫ লাখ টাকা। একটি মৎস্য খামার, ৫ জেলার ১৩টি অকৃষি জমির অর্জনকালীন দাম ৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বাকি ৯টি অকৃষি এবং কৃষি জমিগুলোর দাম উল্লেখ করেননি।হলফনামার বাইরে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মরজাল মৌজার চারটি দাগে লায়লা কানিজের নামে আরও দুই বিঘা (৬৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ) জমির সন্ধান পাওয়া গেছে ভূমি অফিসের নথি থেকে।
প্রসঙ্গত,ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ব্লক-ডি এর ৭/এ সড়কের ৩৮৪ নম্বর বাড়ির ৫০১ নম্বর ফ্ল্যাটকে মতিউর রহমান ও তাঁর স্ত্রী লায়লা কানিজের। লায়লা কানিজ (লাকী) ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন খাদ্য কর্মকর্তা। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে লায়লা কানিজ সবার বড়। তিনি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’ নামের একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলেন । সরকারি কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন, সেই প্রশ্নও এখন সামনে এসেছে। কোরবানির ঈদের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত উপজেলা পরিষদ কার্যালয়েও যাননি লায়লা কানিজ।
দ্বিতীয় স্ত্রীর সম্পদ
এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। প্রায় ১০ বছর আগে সোনাগাজীতে শ্বশুরের ভিটায় শাশুড়িকে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়ে দেন মতিউর রহমান।
বাড়ির কেয়ার টেকার জসিম উদ্দিন বলেন, সর্বশেষ দুই মাস আগেও মতিউর রহমান স্ত্রী শাম্মী আখতার, তাঁদের ছেলে মুশফিকুর রহমান (ইফাত), শাশুড়িসহ সোনাগাজীতে বাড়িতে এসেছিলেন। কয়েক দিন থাকার পর আবার ঢাকায় ফিরে যান। মতিউর রহমানের শাশুড়ি ঢাকায় মেয়ের বাসায় থাকেন।
কাকরাইলে এনবিআরের কার্যালয়ের কাছেই স্কাই ভিউ মমতা সেন্টার নামের একটি আবাসিক ভবনে ১০ তলা বাড়িতে ফ্ল্যাট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
নিরাপত্তা প্রহরী মজনুর বলেন, মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবার আসে আর যায়। এখানে নিয়মিত থাকে না। তারা এখন বাসায় নেই।সর্বশেষ কোরবানির ঈদের ১০ দিন আগে মতিউরকে সেই বাড়িতে দেখেছেন ।১৯৯৮ সালে ৪০ হাজার বর্গফুট ভবনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ তৈরির এই কারখানা। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হওয়ার আগপর্যন্ত সংশ্লিষ্ট নথিপত্র অনুযায়ী, এই কোম্পানির ৩৪ লাখ শেয়ারের মালিক মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতারের নামে।
কোম্পানিতে মালিকানা
পুঁজিবাজারের বাইরে পরিবার ও পরিচিতজনদের নামে কয়েকটি কোম্পানিতে মতিউর রহমান বিনিয়োগ করেছেন বলে জানা গেছে।এর মধ্যে গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অন্যতম।
মতিউর রহমানের শ্যালক নেসার উদ্দিনের নামে রয়েছে ২১ লাখ শেয়ার। তিনি গ্লোবাল শুজ লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে শেয়ারের মালিক। আর গ্লোবাল ম্যাক্সের প্রতিনিধি আবদুর রাজ্জাকের নামে ৭৭ লাখ শেয়ার। এ ছাড়া মো. তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ নামের এক ব্যক্তির নামে ১৪ লাখ শেয়ার থাকার কথা উল্লেখ আছে। ফরহাদ মতিউর রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ফরহাদকে এই কোম্পানির চেয়ারম্যান আর ভাই কাইয়ুম হাওলাদার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত গ্লোবাল শুজ লিমিটিডের মালিকানায়ও বেনামে মতিউর রহমান রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, দুই সন্তান আহমেদ তৌফিকুর রহমান (অর্ণব) নামে ১০ লাখ ও মেয়ে ফারজানা রহমানের (ঈপ্সিতা) নামে ২০ লাখ শেয়ার রয়েছে। মতিউরের ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদারের নামে ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৯০০ ও নুরুল হুদার নামে দেড় লাখ এবং বোন হাওয়া নুর বেগমের নামে ২৪ লাখ ৩৪ হাজার শেয়ার রয়েছে। মতিউরের মেয়ে ফারজানা রহমানের নামে ৪৯ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ শেয়ার ও ছেলে তৌফিকুর রহমানের নামে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ শেয়ার রয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠান অর্ণব ট্রেডিংয়ের নামে সাড়ে ২১ লাখ শেয়ার, সিনারজির নামে ২০ লাখ ৮৫ হাজার ও গ্লোবাল ম্যাক্সের নামে ১ লাখ ৭০ হাজার শেয়ার রয়েছে। এ ছাড়া তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদের দুই ছেলের নামে ৫১ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার রয়েছে।
দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার যে গাড়িটি ব্যবহার করেন, সেটি গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিংয়ের নামে নিবন্ধিত। ছেলে মুশফিকুর রহমান (ইফাত) যে গাড়িতে ব্যবহার করে সেটি নিবন্ধিত এস কে ট্রিমসের নামে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানেরই কার্যালয়ের ঠিকানা রাজধানীর নিকেতনের ই-ব্লক, ৮ নম্বর রোডের মুন আইল্যান্ড ভবনে।আটতলার সি-৮ ফ্ল্যাটে তাঁদের অফিস ছিল। এখন অফিস নাই।‘আপন ভুবন’নামে গাজীপুরে একটি পিকনিক অ্যান্ড শুটিংস্পট রিসোর্ট রয়েছে।এটি চালু হয়েছে প্রায় ১২ বছর।এতে আছে ১৮টি কটেজ, বিভিন্ন রাইডসহ অসংখ্য স্থাপনা। এক রাতের জন্য একেকটি কটেজের ভাড়া ৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকার টিকিট।
সাভারে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ (দশমিক ৩৮ বিঘা) জমি রয়েছে। গাজীপুর সদরের খিলগাঁও মৌজায় ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ (দেড় বিঘা) ,ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমানের (অর্ণব) নামে রায়পুরার মরজাল মৌজায় দুটি খতিয়ানে ২৪ দশমিক ২৫ শতাংশ (প্রায় পৌনে এক বিঘা) জমি আছে।রাজধানীর উত্তরা থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পুবাইলের খিলগাঁও এলাকায় আমিনুল ইসলামের বাড়ির আশপাশে মতিউর রহমান তাঁর ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ৩৫ বিঘা জমি আছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি কর্মচারীদের একাংশ অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বৈধ আয়ে এত সম্পদ কখনোই অর্জন সম্ভব নয়।
বিএনএনিউজ/ রেহানা, ওজি