হাছিনা মুন্নী,বিএনএ ঢাকা : বাংলাদেশের মানুষ জন্মের পর থেকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বেড়ে ওঠে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাসের সঙ্গে যুদ্ধে কখনো জয়ী কখনো পরাজিত হয়। প্রকৃতির এ যুদ্ধে পরাজিতদের অনেকের সলিল সমাধি হয় । এদেশের মানুষ অনেকগুলো প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাস মোকাবেলা করেছে । গত কয়েক দশক ধরে দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবুও পুরোপুরি ভাবে ক্ষুদ্ধ, রুদ্র প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের খাতায় লিপিবদ্ধ প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
১৯৬০ সালে অক্টোবর ( তারিখ জানা যায়নি)। ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির শক্তিশালী ঘুর্নিঝড় আঘাত হানে তৎকালীন চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ঝড়ে প্রভাবে ৫ থেকে ৬ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে মারা যায় উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত প্রায় ১০ হাজার মানুষ । এর ৭ মাস পর ১৯৬১ সালের ৯ মে অতি শক্তিশালী আরও একটি ঘুর্নিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। ওই ঝড়ে সাড়ে ১১ হাজার মানুষ প্রাণ হরান । ১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর নোয়াখালী ও ফেনীতে বঙ্গোপসাগর থেকে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষ প্রাণ হারান। ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্থ হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল। এতে ১১ হাজার ৫২০ মানুষ প্রাণ হারান। ১৯৬৫ সালে মে মাসে বরিশাল ও বাকেরগঞ্জে এবং ডিসেম্বরে কক্সবাজারে দুটি ঝড় আঘাত হানে। এতে বরিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন। কক্সবাজারে প্রাণ হারান ৮৭৩ জন।
১৯৬৬ সালে অক্টোবরে আবারও ঘুর্নিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায়। এতে প্রাণ হারান ৮৫০ জন। ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’ বয়ে যায় । ওই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে।ওই ঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। চার লাখ মানুষ বসতভিটা হারান।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘুর্নিঝড়টি ছিল বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ। ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার। এটি মূলত চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আছড়ে পড়েছিল। ঝড়ের প্রভাবে ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। এই ঘুর্নিঝড়টি ছিল ‘শতাব্দীর প্রচন্ড ও শক্তিশালী ঘুর্নিঝড়’ । এতে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় এক কোটির বেশি মানুষ।
১৯৯৭ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড ও এর আশেপাশের এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে। ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। এতে অন্তত ৫শ মানুষ প্রাণ হারান। এর পরের বছর ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার। এই ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন প্রাণ হারান।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। সমুদ্র থেকে উঠে আসা ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সব কিছু ভেসে যায়। ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রায় ছয় হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। যদিও রেডক্রিসেন্টের হিসাব মতে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার।সিডর খুলনা ও বরিশাল এলাকায় তান্ডব চালায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২টি জেলার ২০ লাখ মানুষ। সুন্দরবনের প্রাণীদের পাশাপাশি অসংখ্য গবাদিপশু মারা যায়।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি হলো নার্গিস। ২০০৮ সালের মে মাসে যেটি মিয়ানমারে আঘাত হানে। এতে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ। ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্থ হয়।
২০০৯ সালে ২৫ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও খুলনা উপকূলে আঘাত হানেঘুর্নিঝড় ‘আইলা’। এই ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় তিন লাখ মানুষ গৃহহীন হয়।
২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ । এটির বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। এই ঝড় বাংলাদেশে ১৭ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় কোমেন । বাতাসের গতি ছিল ৬৫ কিলোমিটার। কোমেনের প্রভাবে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছিল।
২০১৬ সালে ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতে আংশিক আঘাত হানে রোয়ানু । ধারণা করা হয়,ঘুর্নিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির। হঠাৎ এটি দূর্বল হয়ে পড়ে। রোয়ানু-র আঘাতে চট্টগ্রামে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ মে , উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোরা ১৪৬ কিলোমিটার বাতাসের গতিতে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। কিন্তু তেমন প্রাণহানি হয়নি। দুজন নারীসহ তিনজন মারা যায়।
২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ আঘাত হানে। এটিও উপকূলে আসতেই দূর্বল হয়ে পড়ে। এতে নয় জনের মৃত্যু হয়। তবে প্রাণহানি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল অনেক বেশি। সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।
২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বারবার দিক পরিবর্তণ করে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। এতে প্রাণ হারান ২৪ জন। এতে আনুমানিক ২৬৩ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়।
এবার বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ শক্তি সঞ্চয় করে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। আগামী ২৬ -২৭ এপ্রিল ‘ইয়াস’ নামের এ ঝড়টি আঘাত হানতে পারে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের পর এটি হবে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস। আঘাতের ক্ষণটি পূর্নিমায় হওয়ায় আবহাওয়াবিদরা এ ঝড় নিয়ে চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না। ইতোমধ্যে তাদের কপালে বলি রেখা দেখা দিয়েছে। তবে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সমুদ্রে চলাচলকারি সব ধরনের নৌযানকে উপকূলে ফিরে আসতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলা উপজেলার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে বা নিরাপদে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বিএনএনিউজ২৪/ ওয়াইএইচ,এসজিএন