বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খন্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভান্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে। ১ মার্চ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার নেপথ্যে গণ মাধ্যমের ভূমিকা, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
আজ(২১ মার্চ২০২২) প্রকাশিত হলো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৩
বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহবানের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বহু দেশ থেকে বহু মানবদরদী ও শান্তিসংস্থা সেক্রেটারী জেনারেল উ-থান্টের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। এই সব তারবার্তায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলী যেহেতু ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায়’ সেই কারণেই বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। অথচ কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ইয়াহিয়া সরকার তার বেতার, টেলিভিশন ও কূটনৈতিক মিশনসমূহের মাধ্যমে এই ঘটনাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে প্রচার করেছিলো। বাংলাদেশে তাদের সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যাকে তারা বাঙালী-অবাঙালীর মধ্যে সংঘর্ষ ও কতিপয় দুষ্কৃতকারীর কার্যকলাপ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্ত তাদের সে অপকীর্তি বিশ্ববিবেকের চোখে এখন পরিস্কারভাবে ধরা পড়েছে। জানিনা ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার এই কেলেঙ্কারির পর আবার কোন ছেঁদো কাহিনীর আশ্রয় নেবেন- তবে সত্য ঢাকতে গিয়ে, অপরাধ গোপন করতে গিয়ে তারা যে কৌশলই অবলম্বন করুক না কেন পরিণতি তাদের একই হবে। কারণ, খোড়ার পা গর্তেই পড়ে।
২৭ জুন, ১৯৭১
সম্প্রতি বার্লিন থেকে প্রকাশিত জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সরকারের এক ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ব্যাপক গণহত্যা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী আর যাতে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য না হয় এবং ইতোমধ্যেই যে ৬০ লক্ষ বাঙালী দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে তারা যাতে অবিলম্বে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে এবং বাংলাদেশে যাতে তাদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হয় তার জন্য কালবিলম্ব না করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যাতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এইসব কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যেই বাস্তবসম্মত, উপযুক্ত এবং স্থায়ী সমাধানের পথ নিহিত আছে।
জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই ইশতেহারে আরও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা এবং সেখানকার গণনির্বাচিত নেতৃবর্গের পরামর্শ ও পরিকল্পনার ভিত্তিতেই মৌলিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের এক সঠিক ও সহজ পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই ইশতেহারকে বিশ্বের সকল দেশের রাজনৈতিক মহল দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। তাঁরা বলেন, এই ইশতেহারে বাংলাদেশ থেকে যেসব শরণার্থী ভারতে চলে গেছে তাদের সমস্যাকে শুধু যে কেবল আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছে তা নয়। এই ইশতেহারে দাবী করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতার মুক্তি, আওয়ামী লীগের উপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রভৃতি।
ইউরোপ ও আমেরিকার পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনসমূহের প্রকাশিত ও প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ ও মন্তব্যে বলা হয়: গত ২৫শে মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে বর্বরতা চালিয়েছে তাতে বাংলাদেশ থেকে আরো লক্ষ লক্ষ নরনারী দেশছাড়া হতে বাধ্য হবে।
গত ১৯৭০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে যে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিলো তাতে আনুমানিক ১৮ থেকে ২০ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছে এবং এই ব্যাপক প্রাণহানির মূল্যেও পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রচ্ছন্ন কারসাজি ছিলো। যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করলে ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছাসে মৃত্যুর হাত থেকে শতকরা ৯৫ জন অব্যাহতি পেতে পারতো, পশ্চিম পাকিস্তানীরা তথা ইয়াহিয়া সরকার ইচ্ছা করেই সেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি ব্যাপক প্রাণহানির খবরটুকু পর্যন্ত চেপে গেছে। বাইরের জগত যেটুকু জেনেছে তা বাংলাদেশের বেসরকারী কতগুলো পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের খবর থেকে। গত ২৫শে মার্চ থেকে ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালালো, এর খবরও তারা চেপে গেছে। ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী ১০ লাখ নরনারীকে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে।
লণ্ডনে কমনওয়েলথ প্রেস সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকা থেকে এই তথ্য উদ্ধৃত করা হয়। অনেকগুলো পত্র-পত্রিকায় এ রকম মন্তব্য করা হয়েছে যে পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে বর্ণিত মুসা(আ:) এর যুগে মিশরের উপর পর পর যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় এসেছিলো তাতেও এর প্রাণহানি ঘটেনি। পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ পর্যন্ত যত বাঙালী খুন করেছে তার দ্বিতীয় কোন দৃষ্টান্ত নেই। এত নরহত্যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ পর্যন্ত কখনও ঘটেনি।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – ৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৬০-৬১) চলবে
আরও পড়ুন :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০১
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা