১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
যাদের চক্ষু আছে এবং চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন, আজ তাঁদেরকে একবার বাংলাদেশের রণাঙ্গনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ করবো। একবার চোখ খুলে দেখুন আমাদের সংগ্রামী বীর যোদ্ধা বাঙালী যুবকগণ কিভাবে পশ্চিমা পাক হানাদার পশুদের খতম করে ক্রমাগত জয়যাত্রার পথে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত দুর্দিনে পশু পাকসেনাদের হাত থেকে দেশকে সম্পূর্ণ মুক্ত করবার জন্য মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকগণ আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, বিক্রম, ধৈর্য এবং দেশপ্রেমিকতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার নিদর্শন একান্ত বিরল।
একবার চেয়ে দেখুন যশোর রণাঙ্গনের দিকে- আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাত সামলাতে অপারগ হয়ে কিভাবে খানসেনারা পশ্চাদপসারণ করছে। খুলনায় একটি জাহাজ ডুবিয়ে আমাদের সেনারা জাহাজ চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। সিলেট, চাটগাঁ, কুমিল্লা, নোয়াখালী ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া সর্বত্রই আমাদের বীর যোদ্ধাদের অগ্রগতি এবং পাকসেনাদের পরাজয় অব্যাহত রয়েছে। ঢাকায় বেসামাল হয়ে সামরিকচক্র বারবার সান্ধ্য আইন জারি করে নিরীহ নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন করছে। কিন্তু তাই বলে বাঙালীর মনোবল হ্রাস পায়নি। আমাদের বীর সেনাদের অগ্রগতি দেখুন এবং জেনে রাখুন, ইনশাআল্লাহ সময় আর খুব দূরে নাই যখন ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা গৌরবের সঙ্গেই উত্তোলিত হবে।
সে কারণেই বলছিলাম যাঁদের চক্ষু আছে এবং চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন, আজ তাঁরা চোখ খুলে একবার দেখুন- শ্রবণশক্তি যদি বধির না হয়ে থাকে তবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই বিজয় বার্তাগুলো শুনুন। কথাগুলো এইজন্য বলছি যে বাংলাদেশে এখনো কিছু সংখ্যক বাঙালী আছেন যারা চোখ থেকেও অন্ধ এবং শ্রবণশক্তি থেকেও বধির। ঢাকা, রাজশাহী প্রভৃতি বেতার কেন্দ্রে এই জাতীয় কিছু অন্ধ ও বধির বাঙালী এখনো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য দেদার চিৎকার করে যাচ্ছেন। এইসব বাতুলদের তখনই জ্ঞানোদয় হবে যখন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গীরা তাদের গর্দানকে স্পর্শ করবে। যে প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য এখনো কিছুসংখ্যক জন্মদালাল বাঙালী গলদঘর্ম হচ্ছেন তাদের বোঝা উচিত যে আজ ঐসব প্রভুদের কি অবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তানেও বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।
বেলুচিস্তানে বেলুচরা এবং সীমান্ত প্রদেশে পাঠানরা এবার অস্ত্রধারণ করেছে। এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রে বালকোচিত চাপল্যেই যাঁর বৈশিষ্ঠ্য সেই জুলফিকার আলী ভুট্টোর খোদ জন্মভূমি সিন্ধুও আজ বিক্ষুব্ধ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া চক্রের পালাবার স্থানটি পর্যন্ত থাকবে না। এই দুই জানোয়ারের শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথাই আমরা এখন ভাবছি।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র -৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ১০২) চলবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭০
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা