বিএনএ, ঢাকা : প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের কারণে এলোমেলো হয়ে গেছে পুরো শিক্ষাপঞ্জি। সংক্রমণ এড়াতে চলতি বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকবে এই ছুটি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় কোনো ধরণের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি এ সময়ে
ফলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অটোপাস দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করা হয়। আগামী বছরও যথাসময়ে এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে না বলে ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিদালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষাও নেয়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতেয়র কথা বিবেচনা করে দেয়া হয়নি অটোপাসও। ফলে এসব শিক্ষার্থীর পিছিয়ে গেল এক বছর। অন্যদিকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন ও টেলিভিশনে ক্লাস নিলেও প্রযুক্তির অভাব ও খামখেয়ালিপনার কারণে তাতে অংশগ্রহণ করেনি অনেক শিক্ষার্থী।
ক্যাম্পাস বন্ধ ও পরীক্ষা না হওয়ায় অলস সময় কেটেছে তাদের। শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় লেখাপড়ার প্রতিও অনেক শিক্ষার্থী মনোযোগ হারিয়েছেন বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিক চাপ এবং পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় ভুগছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা শঙ্কায় রয়েছেন। করোনার সময় অনেক মেয়ের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন অভিবাবকরা আর অনেক ছেলে ধরেছে পরিবারের হাল।
করোনাকাল কাটিয়ে উঠলে দেখা যাবে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। সবমিলিয়ে করোনার কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ৮ মার্চ। এরপর থেকে বাড়তে থাকে সংক্রমণের গতি। সংক্রমণ এড়াতে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সংক্রমণের পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় সম্ভব হয়নি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া।
সর্বশেষ গত শুক্রবার দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। নিয়মিত রুটিন অনুযায়ী ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। কিন্তু করোনা ঝঁুকির কথা বিবেচনা করে তা বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নানা নাটকীয়তা শেষে ৭ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি বলেন, জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষার ফল নির্ধারণ করা হবে। ফলে অটোপাসে পার পেয়ে যায় সাড়ে ১৩ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী।
পরবর্তীতে অটোপাসে পার পায় জেএসসি, পিএসসি সমমানসহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থী। পরবর্তী ক্লাসে একই রুল থাকবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে বছরের পর বছর অনেক চেষ্টায় সেশনজট কাটিয়ে ওঠার পর করোনার কারণে আবারো সেশনজটে ফিরেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে সব বর্ষের অনার্সের শিক্ষার্থীরা অটোপাস চাচ্ছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের দাবি মানতে নারাজ।
ফলে প্রায় এক বছরের সেশনজটে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। করোনা মহামারী শুরুর আগে অনার্স চতুর্থ বর্ষের ফাইনালের পঁাচটি বিষয়ে পরীক্ষা নেয়ার পর পুরো শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। অপরদিকে প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ ও তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষাও বন্ধ রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে না এলে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর জানায়, বেশ কয়েক বছর থেকে সেশনজট মুক্তভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পরীক্ষা ও ক্লাস সবটাই এখন বন্ধ। করোনা পরিস্থিতি শীতে বাড়তে পারে, সে কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা অটোপাস চাচ্ছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে আগে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তা-ই রয়েছে। শিক্ষার্থীরা গত দুই মাস ধরে অটোপাস চেয়ে আবেদন করলেও উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে পরীক্ষা সম্পন্ন না করে অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে সনদ দেয়া হবে না। আর প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ধৈর্য্য ধরারও অনুরোধ করেন উপাচার্য। তিনি বলেন, আমরা অল্প সময়ের মধ্যে বাকি পরীক্ষাগুলো নিয়ে ফলাফল ন্যূনতম সময়ের মধ্যে দেব। ’ চলতি বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের এক জরিপে বলা হয়, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ৯১ শতাংশ শিশু ও তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিক চাপ এবং পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ায় তারা হতাশায় ভুগছে। তবে এর মধ্যেও শিশু ও তরুণরা এ ভাইরাস রোধে নিজ নিজ কমিউনিটিতে ভূমিকা রাখতে চায়।
‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই জরিপে বলা হয়, মহামারীর সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতনের জন্য সরাসরি তিনটি কারণকে উল্লেখ করেছে শিশুরা।
সেগুলো হলো শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিক চাপ এবং পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া। শতকরা ৭১ ভাগ শিশু ও তরুণ বলেছে, স্কুল বন্ধের কারণে তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ অনুভব করছে।
বিএনএনিউজ/আরিফুল/এইচ.এম।