বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিকারের মধ্যে পেঁপে পাতার রসের উল্লেখ ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, পেঁপে পাতার রসের সঙ্গে কিছু নির্দিষ্ট উপাদান মিশিয়ে তা সঠিক নিয়মে পান করলে ডেঙ্গু থেকে দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে কি পেঁপে পাতার রস ডেঙ্গু নিরাময়ে কার্যকর?
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান জানান, পেঁপে পাতার রস ডেঙ্গু নিরাময়ে কার্যকর—এমন দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কিছু গবেষণা হয়েছে, তবে সেগুলো ‘র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল’ অনুসরণ করে প্রমাণিত হয়নি যে পেঁপে পাতার রস ডেঙ্গু রোগের জন্য কার্যকর।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, কোনো ওষুধ বা প্রতিকার নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর কিনা তা নিশ্চিত হতে হলে বৈজ্ঞানিক নীতির ভিত্তিতে র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের পরীক্ষা ছাড়া কোনো প্রতিকার সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা অসম্ভব।
তবে পৃথিবীর কিছু দেশে ডেঙ্গু রোগীদের পেঁপে পাতার রস খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে ভারতে ৪০০ জন ডেঙ্গু রোগীর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা পেঁপে পাতার রস পান করেছেন, তাদের রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ দ্রুত বেড়েছে এবং তাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তুলনামূলকভাবে কম ছিল। এটি সেই সময় ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’তে প্রকাশিত হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ওয়েবসাইটেও ডেঙ্গুর তীব্রতা নিয়ন্ত্রণে পেঁপে পাতার রসের ব্যবহার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট পরিমাণে পেঁপে পাতার রস খাওয়ালে রোগীর রক্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমে আসে।
এদিকে, নারিকেল তেল মাখলে মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যায় কি না, সেটিও সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা আখতার মনে করেন, যেকোনো ঘন তেল চামড়ার ওপর মশার প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তবে নারিকেল তেলের সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে ব্যবহার করলে তা আরও বেশি কার্যকর হতে পারে। বিশেষ করে কর্পূর বা ন্যাপথলিনের গুঁড়া মিশিয়ে ব্যবহার করলে মশা প্রতিরোধে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া, তেলের কড়া গন্ধের কারণে সরিষার তেলও মশা তাড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।
সব মিলিয়ে, পেঁপে পাতার রস বা নারিকেল তেলের মতো প্রাকৃতিক প্রতিকারগুলো সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তথ্য এখনো অপর্যাপ্ত। সঠিক চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ অনুসরণ করা জরুরি।
পেঁপে পাতার রসে যে ধরনের উপকারী যৌগ রয়েছে
পেঁপে পাতার রসে কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক ও প্রাকৃতিক যৌগ রয়েছে যা শরীরের জন্য বিভিন্ন উপকার করে। যদিও এটি ডেঙ্গু বা অন্যান্য রোগের নিরাময়ে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়, তবে পেঁপে পাতার রসের কিছু উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে বলে ধরা হয়। পেঁপে পাতার রসে যে ধরনের উপকারী যৌগ রয়েছে এবং কীভাবে তা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে:
১. এনজাইম প্যাপেইন ও কাইমোপ্যাপেইন:
– পেঁপে পাতায় রয়েছে প্যাপেইন এবং কাইমোপ্যাপেইন নামক প্রোটিওলাইটিক এনজাইম, যা প্রোটিন ভেঙে সহজে হজম করতে সাহায্য করে। এদের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য শরীরে প্রদাহ কমাতে সহায়ক হতে পারে, যা ডেঙ্গুর মতো সংক্রমণের সময় কাজে আসতে পারে।
২. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহ:
– পেঁপে পাতায় ভিটামিন এ, সি, এবং ই-সহ বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহ শরীরের ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যালকে নিরপেক্ষ করে, যা কোষের ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৩. প্লাটিলেট বৃদ্ধি:
– কিছু গবেষণায় দেখা গেছে পেঁপে পাতার রস প্লাটিলেট বা রক্তের কণিকার সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। ডেঙ্গু রোগে রক্তের প্লাটিলেট সংখ্যা কমে যাওয়া একটি বড় সমস্যা, তাই এই ক্ষমতা রক্তের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে।
৪. আলকালয়েড:
– পেঁপে পাতায় কার্পেইন, পসিন, এবং ডিহাইড্রোকারপেইন নামক কিছু আলকালয়েড থাকে, যেগুলি শরীরে রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। এই উপাদানগুলো অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল প্রভাবও দেখাতে পারে।
৫. অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য:
– পেঁপে পাতায় কিছু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল উপাদান রয়েছে যা ক্ষুদ্র আকারের জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। যদিও এটি ডেঙ্গু নিরাময়ে সরাসরি কার্যকর নয়, তবে অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
৬. অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য:
– পেঁপে পাতায় প্রদাহবিরোধী উপাদান রয়েছে, যা শরীরের বিভিন্ন প্রদাহজনিত সমস্যায় সহায়ক হতে পারে। এটি ডেঙ্গুর কারণে হওয়া ফোলাভাব বা ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
৭. ডাইরেক্টিভ এফেক্টস:
– পেঁপে পাতার রস শরীরের পাচনতন্ত্রে সহায়তা করে এবং পাকস্থলীর অম্লতা ও গ্যাস সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
ব্যবহার ও সতর্কতা:
– পেঁপে পাতার রস খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ অতিরিক্ত পরিমাণে এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে পেঁপে পাতার রস লিভার বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার কারণ হতে পারে।
সবমিলিয়ে, পেঁপে পাতার রসের বিভিন্ন উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, তবে একে শুধুমাত্র ডেঙ্গু বা অন্য কোনো রোগের চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলা সর্বোত্তম পন্থা। সংগৃহীত।
বিএনএনিউজ২৪, এসজিএন