।। ইমরান খান।।
মধ্যরাত। সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে দূরপাল্লার বাস। এর মধ্যেই সিএনজি-অটোরিকশা থেকে এক এক করে নামেন কয়েকজন মধ্যবয়সী নারী। হাতে ছোট ছোট পোটলা। রাত কিছুটা গভীর হলে এমন দৃশ্যের অবতারণা হয় ঢাকার ধামরাইয়ের বারবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। পেশায় এ নারীরা কেউ পোশাক শ্রমিক, কেউ অন্যান্য কাজে যুক্ত। তবে রাতে তাদের পেশা বদলে যায়। তারা কাজ করেন ভাসমান পতিতাবৃত্তির। স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে তারা নিয়মিত যৌন ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। বিষয়টি নিয়ে বিব্রত স্থানীয় সুধীজনরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ও সরেজমিন তদন্তে দেহব্যবসার সত্যতা ও একাধিক চক্রের সন্ধান মিলেছে।রাত বাড়লেই স্ট্যান্ড চলে যায় ’পতিতা ও দালালদের’ দখলে
স্থানীয়রা জানান, রাত ১১-১২ টার পর থেকেই একে একে নারীরা জড়ো হতে থাকেন বারবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দুই লেনের পাশে অবস্থান নেন তারা। এছাড়া মোজাম্মেল সিটি মার্কেটের সামনে, আখির মার্কেটের সামনে, আকিজ ফুডের পাশে ও সোবহান মার্কেটের পাশে তারা অবস্থান নেন। এ সময় ওই নারীদের পাহারায় আশপাশে নিযুক্ত থাকেন স্থানীয় আবু বক্কর মোল্লা, সুমন হোসেন, রিদয় হাসান, আরিফ হোসেন, লিটন ও মান্নান হোসেনসহ আরও কয়েকজন। তারা সবাই ধামরাইয়ের গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মোল্লার অনুসারী।
যৌনকর্মীদের আনাগোনায় বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চলাচল করতে বিব্রত বোধ করেন স্থানীয় চাকরিজীবী ও সুধী জনেরা। বেসরকারি চাকরিজীবী আবুল বাশার বলেন, রাত হলেই ওই নারীরা ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেন। যে কারণে চলাচল করতে বিব্রত হতে হয়।
দিনে শ্রমিক, রাতে যৌনকর্মী
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বারবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে আসা যৌনকর্মীদের বেশিরভাগই আসেন আশপাশের এলাকা থেকে। এরমধ্যে সাভারের নবীনগর, ধামরাই, মানিকগঞ্জের গোলড়া ও সদর এলাকা থেকে আসেন বেশি নারী।
কথা হয় কয়েকজন যৌনকর্মীর সঙ্গে। মুন্নি আক্তার (ছদ্মনাম) নামে এক যৌনকর্মী জানান, তিনি মানিকগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। রাতে যৌনকর্মীর কাজ করেন। একইভাবে দিনে অন্য পেশায় কাজ করার কথা জানান আরও কয়েকজন।
যৌনকর্মীদের ইনকামে ভাগ বসান প্রভাবশালীরা
বারবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে প্রতি রাতে প্রায় অর্ধ শতাধিক যৌনকর্মী আসেন। আশপাশের ঝোপঝাড় ও কয়েকটি ভাড়া বাড়িতে তাদের যৌনকর্ম করানো হয়। প্রতিরাতে ১০-২০ জনের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করতে হয় তাদের
তবে কাজের সরাসরি পারিশ্রমিক পান না তারা।
গ্রাহক সংগ্রহ করা, জায়গা ব্যবস্থা ও গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায় সবই করে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রটি।
যৌনকর্মীরা জানান, প্রতিবার কাজ শেষে একেকজন গ্রাহক গড়ে ১০০-১,০০০ টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকে। কাজ শেষে প্রায় ৫,০০০-৫,০০০ টাকা আয় করলেও একেকজন যৌনকর্মী সেখান থেকে ১,২০০-১,৫০০ টাকা পান। এর প্রতিবাদ করলে তাদের নির্যাতন ও পুলিশের হুমকি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি কম টাকা দেওয়ায় প্রতিবাদ করে মারধরের শিকার হন আনোয়ারা খাতুন (ছদ্মনাম) নামে এক যৌনকর্মী।
তিনি বলেন, ’গ্রাহক কাজ শেষে দালালের কাছে টাকা দেয়। মধ্য রাত থেকে ভোর পর্যন্ত অন্তত ১৫-২০ জন গ্রাহক আসে। তাতে ৪,০০০-৫,০০০ টাকা নেয় দালালরা। কিন্তু আমরা পাই ১,০০০-১,৫০০। একদিন কাজ করলে আবার কয়েকদিন করতে পারি না।’
টাকার ভাগ যায় বহু পকেটে
যৌনকর্মীদের এই টাকার ভাগ দৈনিক হিসেবে যায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের পকেটে।
সূত্র বলছে, স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মোল্লা, গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমজাদ মোল্লা, ইউপি সদস্য ইমান আলী, বারবাড়িয়া-চারিপাড়া যুবক সমিতির নেতা আলতাফ হোসেনসহ আরও কয়েকজন যৌনকর্মীদের টাকা থেকে ভাগ নেন।
আবু বক্কর মোল্লা বলেন, ”এসবের কিছুই জানিনা ভাই। এসব অবজব কথা। একজনকে ছোট করার লাইগ্যা অনেকে অনেক চাল চালে। বর্তমানে আমি ফার্নিচারের ব্যবসা করে খাই। কোন জায় ঝামেলায় নাই। এগুলো পছন্দ করি না। আর আল্লাহ যেন এসবের মধ্যে না নাই।”
এদিকে বিষয়টি সম্পর্কে বক্তব্য জানতে গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মোল্লাকে কল দেওয়া হলে প্রশ্ন শোনার পর তিনি কল কেটে দেন। এরপর তিনদিন ধরে কল দেওয়া হয়, তবে তিনি কল ধরেননি। সোমবার ও মঙ্গলবার দুপুরে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে তার কক্ষটি বন্ধ পাওয়া যায়। মঙ্গলবার বিকেলে তার অনুসারী পরিচয়ে কল দিয়ে দেখা করতে বলেন এক ব্যক্তি। তবে তারপর তিনিও আর কল ধরেননি।
ধামরাই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় মালো বলেন, এবিষয়ে আমি কিছু জানি না।
সম্প্রতি ধামরাই থানায় সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের এক মতবিনিময় সভায় বারবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে যৌন ব্যবসার বিষয়টি উঠে আসে। বিষয়টিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন অর রশিদ।
বিএনএ/ ওজি